জন্ম তারিখ: ১৫ অক্টোবর, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতে স্থান: রামপুরা, বনশ্রী
মারুফ হোসেন ছিলেন কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র, যিনি তার ইন্টার্নশিপের জন্য রাজধানী ঢাকায় এসেছিলেন। ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে, তিনি শুরু থেকেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই আন্দোলনটি কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে হলেও সময়ের সাথে তা শেখ হাসিনার সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪, এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। শহীদ মারুফ এই ঐতিহাসিক বিজয়ের অংশীদার, যদিও তিনি নিজে তা দেখে যেতে পারেননি।জন্ম ও পরিচিতি মারুফ হোসেন কুষ্টিয়ার খোকসা পৌর এলাকার থানা পাড়ার শরিফ উদ্দীনের বড় ছেলে। কুষ্টিয়া পলিটেকনিক থেকে শেষ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে ইন্টার্নশিপ করতে তিনি ঢাকায় আসেন, যেখানে রামপুরা বনশ্রী এলাকায় বন্ধুদের সাথে একটি মেসে থাকতেন। মারুফের পরিবার তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। মেধাবী ছেলে ইন্টার্নশিপ শেষে চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবেন, এটাই ছিল তাদের আশা। ব্যক্তিগত জীবন মারুফের বাবা ছিলেন ফুটপাতে ফল বিক্রেতা, আর্থিক কষ্টের মাঝেও তিনি তার পরিবার চালানোর চেষ্টা করতেন। মারুফ ফ্রিল্যান্সিং করে বাবাকে আর্থিক সহযোগিতা করতেন এবং সবসময় বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, “আর কিছুদিন ধৈর্য ধরো, চাকরি নিয়ে সব ঠিক করব।” মারুফ ছিলেন ভদ্র ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ। বাবা রাগ হলে তিনি চুপচাপ থাকতেন এবং মাকে বলতেন, “এখন বাবার সাথে কথা বলার দরকার নেই, রাগ কমলে সব ঠিক হয়ে যাবে।” আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে জনগণ নানান অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন ও জুলুমের নির্মম ভুক্তভোগী। এদেশের মুক্তিকামী জনতা সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে এহেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে হুংকার দিয়ে সংগ্রামী জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ছাত্রবৃন্দ। উপরুন্তু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সাক্ষী, দেশের ক্রান্তিকালে বরাবরই ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতি, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নিগিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয়। আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, পুলিশ ও জঅই সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। আন্দোলনে যোগদান কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। মারুফ শুরু থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিয়মিত অংশ নিতেন। শাহাদাত বরণ ১৯ জুলাই, ২০২৪, মারুফের জীবনের শেষ দিন ছিল। এর আগের দিন টিয়ারশেলের ধোঁয়া খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেদিন সকাল ১১টায় মায়ের সাথে তার শেষ কথা হয়। তখনো তিনি খাননি। মারুফ বলেছিলেন, ঢাকার অবস্থা ভালো না। এ কথা শুনে মা সতর্ক করে বলেছিলেন, বাপ বাইরে বার হবা না, সে সময় সায় দিয়েছিলেন মারুফ। তখন মাকে সান্তনা দেয়ার জন্য এই কথা বলেছিলেন। বিকেল ৩টার দিকে রামপুরা বনশ্রীর সামনের আন্দোলনে অংশ নেন। সেখানে স্বৈরাচারী ফ্যাসীস্ট সরকারের তবেদার ঘাতক পুলিশ, বিজিবি এবং র্যাব নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। এসময় একটি গুলি তার পিঠে লেগে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়। বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে নিকটস্থ এডভান্স ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ২০ জুলাই, সকালে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাতে খোকসা পৌর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। শহীদ সম্পর্কে শিক্ষকের বক্তব্য খোকসা সরকারী পাইলট স্কুলের শিক্ষক বলেন, মারুফ হোসেন নম্র ভদ্র ও ধর্মভীরু ছিল। বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে সে ভূমিকা পালন করত। খোকসা থানা মসজিদে প্রতি বছর তার উদ্যোগে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন। তাঁকে হারিয়ে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। স্মৃতি কথা মারুফের বাবা শরিফ উদ্দীন ছেলের শহীদ হওয়ার ছয় ঘণ্টা আগে তার সাথে কথা বলেছিলেন। তিনি কখনো ভাবেননি যে সেটাই হবে তাদের শেষ কথা। তিনি ছেলের মুখ দেখে বিদায় জানান, কিন্তু ভীষণ কষ্টে থাকা শরিফ উদ্দীন, ছেলের ক্ষত চিহ্ন দেখতে পারেননি। ছোটবেলায় মারুফের প্রিয় সাইকেলটি এখনো ঘরে আছে, কিন্তু সাইকেলের মালিক আর নেই। মারুফের পরিবারের সদস্যরা এখনো সন্ধ্যার পর ফোনের অপেক্ষায় থাকেন, কিন্তু সেই ফোন আর আসে না। মারুফের স্কুলের শিক্ষকরা এবং প্রতিবেশীরা তাকে একজন নম্র, ভদ্র এবং ধর্মভীরু মানুষ হিসেবে স্মরণ করেন। তিনি সবসময় সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিতেন এবং খোকসা থানা মসজিদে প্রতি বছর ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন। পারিবারিক অবস্থা শহীদ মারুফ হোসেন এর বাবা খোকশা বাজারের পাশে নিজের ছোট্ট একটি জমিতে ঘর করে থাকেন। মারুফের মা এবং ছোট বোনসহ কোনো রকম জীবনযাপন করেন। ছোট মেয়ের পড়াশুনা এবং পরিবারের খরচ মেটাতে অনেক কষ্ট হয় তার। শহীদের বাবা ক্ষুদ্র ফল-ব্যবসায়ী। ফুটপাতে ফল বিক্রি করেন। ব্যাবসা থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে সংসারের খরচ পরিচালনা করেন। শহীদ মারুফ বেঁচে থাকতে ফ্রিল্যান্সিং করে বাবাকে আর্থিক সহযোগিতাও করতেন। একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: মারুফ হোসেন পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ : ১৫-১০-২০০৪ ঘটনার স্থান : রামপুরা, বনশ্রী আক্রমণকারী : বিজিবি’র গুলিতে আহত হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই, ২০২৪, বিকাল ৩.০০টা শাহাদাতের তারিখ : ১৯ জুলাই, ২০২৪, বিকাল ৪.৩০টা, রামপুরা, বনশ্রী, ঢাকা দাফনের স্থান : খোকসা কেন্দ্রী গোরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: খোকসা থানা পাড়া, ইউনিয়ন: খোকসা পৌরসভা, থানা: খোকসা, জেলা: কুষ্টিয়া পিতা : মো: শরিফুল ইসলাম, ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ী, ৪৭ বছর মাতা : মোসা: ময়না খাতুন, গৃহিনী, ৪০ বছর ছোট বোন : মোসা: আয়েশা খাতুন, বয়স: ১০ বছর প্রস্তাবনা ১. ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য আর্থিক সহযোগিতা করা প্রয়োজন ২. ছোট বোনের ভালোভাবে পড়ালেখার যাবতীয় ব্যবস্থা করা ৩. এককালীন আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা