জন্ম তারিখ: ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা :গাড়ি চালক, শাহাদাতের স্থান :দেবীদ্বার সদরের আজগর আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে।
আব্দুর রাজ্জাক রুবেল দেবিদ্বার এলাকার একজন সাহসী যুবক। নিহত রুবেলের স্ত্রী হ্যাপি আক্তার জানায়, বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে, তার বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরেছিল রুবেল। গাড়ি চালিয়ে স্ত্রী, সন্তান ও মাকে নিয়ে জীবন যাপন করতো। রুবেল ও হ্যাপি দম্পতির নৌফা নামের একটি ছয় বছরের মেয়েও আছে। আন্দোলনের সময় রুবেলের স্ত্রী হ্যাপী আক্তার ছিলেন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট কুমিল্লার দেবিদ্বারে গুলিতে নিহত হন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুর রাজ্জাক রুবেল। কুমিল্লা উত্তর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের জন্য শহীদ রুবেলের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। তার আত্মত্যাগের বিনিময়ে একজন স্বৈরাচারী হাসিনার পতন হয়েছে। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে জনগণ নানান অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন ও জুলুমের নির্মম ভুক্তভোগী। এদেশের মুক্তিকামী জনতা সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে এহেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে হুংকার দিয়ে সংগ্রামী জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ছাত্রবৃন্দ। উপরুন্তু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সাক্ষী, দেশের ক্রান্তিকালে বরাবরই ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। বাংলাদেশ নামক গাড়িটা যখন এমনভাবে ব্রেক ফেইল করলো আর বাংলাদেশী নামক যাত্রীরা যখন আতঙ্কিত; চারদিকে যখন কষ্ট, বেদনা, চিৎকার, আহাজারি আর নিশ্চিত ধ্বংসের সুস্পষ্ট লক্ষণ, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন বর্বরতা তরুণ প্রতিবাদী সমাজ সচেতন আযিযুল মিয়ার দেখে মনে আঁচড় কাটতে পারে। কেননা সবকিছু তো তার সামনেই ঘটছে। তিনি নিজের কানেই শুনছেন মানুষের নিদারুণ আর্তনাদ; ব্যথিত মনের হাহাকার। নিজের চোখে দেখছেন কিভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে শাসক নামধারী শোষক গোষ্ঠী। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতিন, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নেয়গিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয় । আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, জঅই সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। যেভাবে শহীদ হলেন আবদুর রাজ্জাক রুবেলকে গত ৪ আগস্ট উপজেলা সদরের আজগর আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসী ঘাতক আওয়ামী লীগের লোকজন রামদা দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। তিনি পৌর এলাকার বারেরা গ্রামের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাগুত সরকার গণমানুষের উপর যে হত্যাকান্ড চালিয়েছে, সেই আন্দোলনের একজন দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধা আব্দুল রাজ্জাক। চারদিকের গোলাগুলির শব্দে নিজেকে ঘরবন্দী না করে সাধারণ ছাত্রজনতার বিপ্লবী আন্দোলনকে আরো সোচ্চার করতে সকাল ১০ টায় বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যোগদান করেন আবার বাসায় আসেন। কিছুক্ষণ পর আবার বাসা থেকে বের হলে ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশবাহিনীর গুলি এসে তার বুকে লাগে। এই অবস্থায় তাকে দেবিদ্বার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, তিনি আরও আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। ৪ আগস্ট দেবিদ্বার এলাকার সকল নিউজ মিডিয়ার তথ্য ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৪ আগস্ট দেবিদ্বার আন্দোলনকারীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের অধিকারের পক্ষে এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে। বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন ঢাকা পোস্ট, কুমিল্লার কাগজ, আজকালের খবর এবং সময় টেলিভিশনে এই ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। আন্দোলনটি শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও পুলিশের সহিংস আক্রমণে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। দুপুরের দিকে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ারগ্যাস এবং সরাসরি গুলি ছুঁড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। সহিংসতার ফলে বহু শিক্ষার্থী আহত হয়, এবং রুবেল নির্মমভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, আন্দোলনকারীরা পুলিশি আক্রমণের মুখে কিছুটা পিছু হটলেও তাদের দাবির প্রতি দৃঢ় ছিলেন। গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয় যে, আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ দাবিকে প্রশাসন কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করেছিল, যা আরও বেশি সহিংসতার সৃষ্টি করে। এছাড়া, স্থানীয় মানুষ এবং সাংবাদিকরা পুলিশের আক্রমণকে অপ্রত্যাশিত ও অনুচিত বলে উল্লেখ করেন। শহীদ সম্পর্কে বিশেষ তথ্য: মৃত্যুর ৩৬ দিন পর বাবা হয়েছেন আবদুর রাজ্জাক রুবেল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট কুমিল্লার দেবিদ্বারে গুলিতে নিহত রুবেলের স্ত্রী হ্যাপী আক্তার ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। নিহত রুবেলের বৃদ্ধা মা হোসনেয়ারা বেগম নাতিকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন। তিনি বলেন, বাবারে আমার ছেলে আজ বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হইতো। কপাল পোড়া নাতিটা জন্মের পর তার বাবার মুখ দেখতে পারল না। বড় হয়ে বাবাকে খুঁজলে আমি কী জবাব দেব? রুবেলের স্ত্রী বলেন, আমার স্বামীর ইচ্ছা ছিল ছেলে সন্তান হলে রাইয়ান নাম রাখবেন। নাম রাইয়ানই রাখা হয়েছে। আমার একটি সুখী পরিবার ছিল, একটি গুলিতে নিভে গেল সব। সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারল না তার বাবা। আমার স্বামীর কি অপরাধ ছিলো তাকে কেন ঘাতকরা গুলি করে মারল? পারিবারিক অবস্থা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেলের পরিবারের পরিস্থিতি সত্যিই হৃদয়বিদারক। তার পত্নী গর্ভবতী এবং সব বোন বিবাহিত হওয়ায় পরিবারটি পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারটিকে সাহায্য করা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সমাজ বা সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে, যেন পরিবারটি এই কঠিন সময় কাটিয়ে উঠতে পারে। শহীদের আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবারের সুরক্ষা ও ঐক্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শহীদ থেকে প্রেরণা রুবেলের সাহসিকতা এবং তার আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস। একজন সংসারী হয়েও সে যেভাবে নিজের দেশের জন্য এবং সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে জীবন দিয়েছিল, তা বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থী এবং যুবসমাজকে ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে উৎসাহিত করবে। তার সাহসিকতা, আত্মত্যাগ, এবং দেশপ্রেম শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক সাহস জাগাবে এবং তারা নিজেরাও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ হবে। রুবেলের এ মহান আত্মত্যাগ একটি প্রমাণ যে, দেশের জন্য ভালোবাসা এবং ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করতে বয়স কোনো বাধা নয়। তার জীবন এবং মৃত্যু বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা সকল মানুষের জন্য একটি আদর্শ এবং উদাহরণ হয়ে থাকবে। এক নজরে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেল নাম : শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেল পেশা : গাড়ি চালক জন্ম তারিখ ও বয়স : ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১, ৪৩বছর আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী সরকারের ঘাতক পুলিশ আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ৪ আগস্ট ২০২৪, আনুমানিক দুপুর ১.৩০ টা শাহাদাত বরণের স্থান : দেবীদ্বার সদরের আজগর আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাফন করা হয় : নিজ গ্রামে কবরের জিপিএস লোকেশন : ২৩ক্ক৩৬'০৯.১"ঘ ৯০ক্ক৫৯'৪৮.৬"ঊ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বারেরা, ইউনিয়ন: দেবীদ্বার, পৌরসভা: ৯ নং ওয়ার্ড, থানা/উপজেলা: দেবীদ্বার, জেলা: কুমিল্লা পিতা: রফিকুল ইসলাম মাতা : হোসনে আরা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : ভিটেমাটি ও কিছু জমি প্রস্তাবনা ১. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া প্রয়োজন ২. মেয়েকে পড়াশোনার খরচের ব্যবস্থা করে দিলে উপকার হবে