জন্ম তারিখ: ১৫ নভেম্বর, ১৯৯৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : শ্যামলী গাড়িতে সুপারভাইজার, শাহাদাতের স্থান : রাজধানীর আবদুল্লাহপুর।
১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর বাবা সফিকুল ইসলাম সরকার ও মা হাজেরা বেগমের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় শহীদ মো: ফয়সাল সরকার। সে ছিল পরিবারের ছয় মেয়ের পর প্রথম সন্তান। কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কাচিসাইর গ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে উঠা। অভাবের সংসারে জীবীকার তাগিদে শ্যামলী গাড়িতে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতো সে। ফয়সাল এস এম মোজাম্মেল হক টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতিন, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নিগিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয়। আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, র্যাব সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। আন্দোলনে যোগদান ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার বিকালে বিপ্লবী মো: ফয়সাল সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। সে আব্দুল্লাহপুর এলাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেয়। যেভাবে শহীদ হলেন শহীদ ফয়সাল সরকার ছিলো একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। সে পরিবারের ব্যয় ভার বহন করার জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি শ্যামলী গাড়িতে সুপারভাইজার হিসেবে পার্ট টাইম কাজ করতোপ। ফয়সাল কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন নিয়মিত সহযোগী হিসেবে অংশগ্রহণ করতো। সে গত ১৯ জুলাই বিকেলে আব্দুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহন কাউন্টারে যাবে বলে বাসা থেকে বের হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন কে কেন্দ্র করে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকায় ঘাতকের ছোঁড়া গুলি মাথায় বিদ্ধ হয়। পরিবারের সদস্যরা কোথাও তার খোঁজ না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণ খান থানায় জিডি করি। ১২ দিন পর বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে; তারা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখালে সেখানে ফয়সালের মরদেহের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। কোথায় দাফন করা হয়েছে জানতে চাইলে তারা জানায়, ১০১৫টি লাশ একবারে গণকবর দেওয়া হয়েছে, কাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে তারা তা বলতে পারবেন না। অশ্রুময় চোখে শহীদ ফয়সালের বাবা, বৃদ্ধ মো: সফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমার ছয় মেয়ের পর ফয়সাল হইছে।’ কেমন আছে ফয়সালকে হারিয়ে তার পরিবার শহীদ ফয়সাল কে হারিয়ে তার পরিবারে এক অন্ধকারের বিষণ্নতা ছেয়ে পড়েছে। কারণ শহীদ ফয়সাল ছিল সংসারের চালিকাশক্তি। শহীদ ফয়সালের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তার মায়ের অশ্রুসিক্ত আর্তনাদ, "আমার ছেলের জীবনডারে কেউ ভিক্ষা দাও, আহারে আমার নিমাইরে এমনভাবে গুলি করছে যে মাথার মগজ ও খুলি উড়ে গেছে। কোন পাষণ্ড আমার ছেলেরে গুলি করছে, তার কি একটু বুক কাঁপল না। পোলারে কত জায়গায় খুঁজছি, কেউ বলতে পারেনি কই আছে, থানায় গেছি, এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ঘুরছি, কোথাও পাইনি। ১২ দিন পর জানছি, আমার ছেলেরে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করছে, আমার মানিক চানরে কই দাফন করছে তাও জানি না, কবরে দাঁড়াইয়া যে ফয়সাল বইল্ল্যা ডাক দেমু, তাও পারমু না, আরে ফয়সালরে তুই কই গিয়া শুইয়্যা আছত।" এভাবেই আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মমতাময়ী মা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজধানীর আবদুল্লাহপুরে মাথায় গুলিবিদ্ধ শহীদ ফয়সাল সরকারের মৃত্যু ও কবর সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। কিন্তু শহীদ ফয়সাল আহত হন ১৯ জুলাই। আহত হওয়ার ১২ দিন পর জানতে পারে ফয়সালকে গণকবর দেয়া হয়। প্রতিবেশীর বক্তব্য শহীদ ফয়সাল একজন ভদ্র ছেলে ছিল। সে আন্দোলনে নামাজ পড়ে অংশগ্রহণ করতো। বাড়িতে সকলের সাথে মিলেমিশে থাকত। সে কঠোর পরিশ্রমী ও অমায়িক ছেলে ছিল। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা শহীদ ফয়সাল একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। সে নিজেই ছিলো পরিবারের একমাত্র জীবিকার অবলম্বন। সে পড়াশোনার পাশাপাশি শ্যামলী গাড়িতে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতো। এখন পরিবারের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি আর নাই। বর্তমানে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। পরিবার চালানোর মতো সম্বল হিসেবে আছে কিছু ভিটা-জমি। জানাযা ও দাফন শহীদ ফয়সাল সরকারকে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে গণ কবর দেওয়া হয়। এক নজরে শহীদ শাহাদাত মো: ফয়সাল সরকার নাম : মো: ফয়সাল সরকার পেশা : শ্যামলী গাড়িতে সুপারভাইজার জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৫-১১-১৯৯৯ ও ২৫ বছর (প্রায়) স্হায়ী ঠিকানা : গ্রাম: কাচিসাইর, ডাকঘর: ধামতী, উপজেলা: দেবিদ্বার, জেলা: কুমিল্লা পিতা : সফিকুল ইসলাম সরকার মাতা : হাজেরা বেগম বিশেষ তথ্য : শহীদ ফয়সাল আহত হন ১৯ জুলাই আহত হওয়ার ১২ দিন পর জানতে পারে ফয়সালকে গণকবর দেয়া হয় প্রস্তাবনা ১. শহীদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান করা ২. ছোট ভাইয়ের পড়াশুনার ব্যবস্থা করা ৩. একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষের মৃত্যুতে অসহায় পরিবারের নিয়মিত খোঁজখবর রাখা