জন্ম তারিখ: ৩ মে, ২০০০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: চাকরি (অফিস সহকারী) শাহাদাতের স্থান: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
চব্বিশ বছরের টগবগে যুবক রাকিব হোসেন। পৈতৃক নিবাস মুন্সিগঞ্জে। থাকেন ঢাকায়। তারা দুই বোন এক ভাই। মা হাসি আক্তার চাকরি করেন। রাকিব বিবাহিত ছিলেন। মা, বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে চলছিল তাদের সুখের সংসার। তার পিতার নাম চাঁদ মিয়া। স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : মোসা, ইউনিয়ন: কোমারভোগ, থানা: লৌহজং, জেলা: মুন্সীগঞ্জ। বর্তমান ঠিকানা : বাসা: ৩১৭, এলাকা: আনন্দনগর, থানা : আফতাব নগর, জেলা: ঢাকা। যেভাবে শহীদ হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দেলনে যুক্ত হতে বাসা থেকে বের হন তিনি। সেদিন ১৯ জুলাই শুক্রবার। রাকিবের মতো আরও বহু লোক ততদিনে যুক্ত হয়ে গেছেন আন্দোলনে। আন্দোলন তখন কাঁপিয়ে দিয়েছে স্বৈরশাসকের ভীত। বিগত পনের বছর যাবত ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ। ক্ষমতার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে হাসিনা সরকার ততদিনে এক দৈত্যে পরিণত হয়েছে। লক্ষ তাদের ৪১ সাল। কেউ কথা বলতে পারে না। হাসিনা সরকারের পনের বছরে বাঘা বাঘা মুখ নিখোঁজ হয়ে গেছে। তারা গুম হয়ে হারিয়ে গেছে। ৫ আগস্টের পর জাতি জানতে পারল হাসিনার একটি আয়নাঘর ছিল। সভ্যতার ইতিহাসে আয়নাঘর অসভ্য কলংক। বিরোধী দলীয় বলিষ্ঠ কণ্ঠ ইলিয়াস আলী। কেউ জানে না কোথায় তিনি। আগস্টে হাসিনা পলায়নের পর জাতি জানলো তাকে মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে গুলি করে খুন করা হয়েছে। তার লাশ পেট ফেড়ে বুকে পাথর বেঁধে তলিয়ে দেওয়া হয়েছে চিরতরে। স্ত্রী পুত্র কন্যারা আর কোনোদিন জানতেও পারবে না তার খবর। এমনকি পিতা, স্বামীর কবরের পাশে দাঁড়ানোর মতো স্মৃতিটুকুও নিঃশেষ করে দিয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী দুঃশাসন একটি কালো অধ্যায়। এরকমই অনিয়ম,নিপীড়ন, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ছিল পুরো জাতি। পনের বছরে হাসিনার সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে বহুবার আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু নিপীড়নের মাধ্যমে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে আন্দোলনের গতিপথ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় কোটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে। একটি যৌক্তিক দাবীকে হাসিনা সরকার তার স্বভাবসুলভ আচরণে অগ্রাহ্য করে। আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রেও তারা তথাকথিত ট্যাগের রাজনীতির কু অভ্যাস অবলম্বন করে। আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত, জঙ্গী, রাজাকার বলে উড়িয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু এবার এতে কাজ হয়নি; উল্টো আন্দোলন আরও চাঙ্গা হয়। প্রাথমিকভাবে আন্দোলন ছিল হল কেন্দ্রিক। ক্রমশঃ তা ছড়িয়ে পড়ে টিএসসি, রাজু ভাস্কর্যসহ পুরো ক্যাম্পাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যোগ দেয় আন্দোলনে। আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে জনতা। ছাত্রদের সাথে যোগ দেয় অধিকার বঞ্চিত সাধারণ সব মানুষেরও। রাকিব হোসেন একজন সাধারণ মানুষ। সাধারণ হলেও তিনি ছিলেন সচেতন মানুষদের একজন। জুলাইয়ের আন্দোলনও তার কাছে যৌক্তিক আন্দোলন বলেই মনে হয়েছিল। মনে করার বহুবিধ কারণও আছে। দেশের মানুষ নানা কারণেই ফুঁসেছিল। জুলাইয়ের বিপ্লবে বিস্ফোরণ হল। দ্রোহ, ক্ষোভ সব প্রকাশের উপলক্ষ এই আন্দোলন। আর তাই এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে যান রাকিব। এদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা গদি রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। হানাদার বাহিনীর মতো আক্রমণ করে নিজের দেশের জনতার উপর। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে দেশের মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধবাজ নেতার মতো। জুলাইয়ের আন্দোলন দমন করতে শত্রু সেনা খতম করার মতো হত্যা করে নিজের দেশের মানুষকে। লেলিয়ে দেয় পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীকে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেও হত্যা করে নিরীহ জনতা। রেহায় পায়নি ঘরের ভিতর বৃদ্ধ, শিশু নারী পুরুষ। ১৮-১৯ জুলাই দেশকে শেখ হাসিনা অবরুদ্ধ করে রাখে। সরকারী বাহিনীর সাথে যোগ দেয় আওয়ামীলীগের বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী। তারা মানুষকে খুন করে নির্বিচারে। ১৯ জুলাই আন্দোলনে দেশের সচেতন জনতা সানন্দে যোগ দেয়। একটি স্বাধীন দেশে অধিকার আদায়ের মিছিলে নির্বিচারে গুলি! সচেতন কেউ মেনে নিতে পারেনি। সভ্যতার ইতিহাসে এগুলো নজিরবিহীন ঘটনা। আন্দোলনের একটি পর্যায়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জারি করা হয়েছিল কারফিউ। এমতাবস্থায়, ভাড়া বাসা থেকে রাকিব বেরিয়ে আসেন রাজপথে, যোগ দেন আফতাব নগর পয়েন্টে। স্বৈরাচার হাসিনার পুলিশ বাহিনী ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা এক যোগে সেদিন আক্রমণ চালিয়েছিল আফতাব নগর ও রামপুরার মাঝামাঝি স্থানে। ফলে, এলাকাটি পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। আনুমানিক বেলা ১২ টার দিকে রাকিব গুলিবিদ্ধ হন। সারা শহর তখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কোথাও যাওয়া যায় না। সড়কে যানবাহনও ছিল না। আন্দোলনকারীরা বহু কষ্টে রাকিবকে হাসপাতালে নেয়। এদিকে রাকিব বাসায় ফেরেনি। মা ও বোন দুঃশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়ে। রাকিবের স্ত্রী আগেই চলে গিয়েছিল বাপের বাড়ি। কারণ দিন কয়েক আগে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহের ঘটনা ঘটেছিল। বিষয়টি কেবল স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাঝেই সীমিত ছিল। রাকিব তার মাকেও জানতে দেয়নি। মা তবুও জেনে যান। পুত্রবধুকে আসতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি আসেননি। ফলে বাসায় ছিল কেবল মা আর বোনেরা। রাস্তায় কারফিউ, নেট নেই- এরকমই এক দুর্দশার ভেতর তারা খুঁজতে থাকেন রাকিবকে। রাকিবের মা একজন সংগ্রামী নারী। বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। মা একাই সামলে চলেছেন পরিবারের সকল দায়দায়িত্ব। রাকিব তার একমাত্র পুত্র সন্তান। তিনিও হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ছেলে রাকিবকে। অবশেষে তিনি পেলেন সন্তানকে কিন্তু লাশ হিসেবে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। হাসিনার পুলিশ এক দুঃখী মায়ের বুক খালি করল নিজের গদি রক্ষার্থে। রাকিব হোসেন দেশের মানুষের জন্য হয়ে গেলেন শহীদ। তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঝালকাঠি নানার বাড়িতে। ওখানেই স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি বোন তামান্না আক্তার, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তার চোখে বেদনার সমুদ্র। “আমার ভাই! পৃথিবীতে তার মতো আর কাকে পাব? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর নাই কারও কাছেই। আমার ভাই খুব ভালো ছিল, বিনয়ী ছিল, হাসি খুশি ছিল। আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। আপনারা আমার ভাইয়ের খুনিদের বিচারের দাবী জানায়েন। আমরা তো গরীব। কার কাছে যাব? কোথায় বিচার চাইব? আপনারা আমাদের দাবীটা পৌঁছে দিয়েন।” এক নজরে শহীদ রাকিব হোসেন নাম : রাকিব হোসেন পিতা : চাঁদ মিয়া মা : হাসি আক্তার। শহীদের পরিবার : মা ও দুই বোন স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : মোছা, ইউনিয়ন: কোমারভোগ,থানা: লৌহজং, জেলা: মুন্সীগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : বাসা: ৩১৭ এলাকা: আনন্দনগর। থানা : আফতাব নগর, জেলা: ঢাকা। শাহাদাত বরণ : ১৯ জুলাই ২০২৪ স্থান : আফতাব নগর, রামপুরা, ঢাকা সময় : পুলিশের গুলিতে আহত হয় বেলা ১২ টায়। মারা যান দুপুর ২.৩০ ঢাকা মেডিকেল মর্গে লাশ পাওয়া যায় তিনদিন পর দাফন : ঝালকাঠি (নানাবাড়ি) প্রস্তাবনা ১. এককালীন আর্থিক অনুদান দিলে পরিবারটি স্বাবলম্বী হবে ২. তাদেরকে মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে ৩. বাসস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি ৪. ছোট বোনটির পড়ালেখার সহযোগিতা করা