Image of পারভেজ বেপারী

নাম: পারভেজ বেপারী

জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০১

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: চট্টগ্রাম

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : কাঠমিস্ত্রী শাহাদাতের স্থান : রামপুরা, ঢাকা

শহীদের জীবনী

শহীদ পরিচিতি কীর্তিমানের কখনো মৃত্যু হয় না। কী জাগ্রত কী নিশীথে কীর্তিমানরা চিরঞ্জীব হয়ে থাকেন প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের হৃদয়ে ঠিক তেমনি রয়ে যাবে চাঁদপুরের বেপারী পারিবারের পারভেজ বেপারী। তিনি একজন সংগ্রামী ও সাহসী যুবক ছিলেন। পারভেজ ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর থানার অন্তর্ভুক্ত বারহাতিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মো: সবুজ বেপারী এবং মাতা শামসুন নাহার। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে পারভেজ ছিলেন সবার বড়। পরিবার প্রধান বাবা অসুস্থ থাকায় তিন বোনসহ সমস্ত পরিবারের দায়িত্বও নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। অভাবের সংসারে বড় হওয়া পারভেজ বেশি দুর পড়াশোনা করতে পারেননি। পঞ্চম শ্রেণি অব্দি পড়াশোনা করার পরে দরিদ্রের কষাঘাতে এবং পরিবারের দায়িত্ব নিতে ছুটে চলেন রাজধানীর উদ্দেশ্য। তিনি ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করতে শিখেছিলেন। দরিদ্রতার কষ্ট, কঠোর পরিশ্রম আর পরিবারের প্রতি গভীর ভালোবাসা পারভেজকে তৈরি করেছিল বাস্তবিক জীবন সংগ্রামের একটি মূর্ত প্রতীক। শহীদ পারভেজ বেপারীর অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ পারভেজই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় একটি আসবাবপত্রের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। সেই সুবাদে থাকতেন উত্তর বাড্ডা এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। কাজ করে যা পেতেন, তা দিয়েই চলত পরিবারটির সংসার খরচ। আগে লঞ্চে শ্রমিকের কাজ করতেন পারভেজের বাবা সবুজ বেপারী। এখন অসুস্থ হয়ে বাসায় বেকার বসে আছেন। ফলে পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব পারভেজের কাঁধে ছিল, ছোট তিন বোনের লেখাপড়াসহ সব খরচও তাকে চালাতে হতো। মাস শেষে ৫০০ টাকা নিজের হাতে রেখে, বাকি সব টাকা পরিবারকে পাঠিয়ে দিতেন। অর্থের অভাব থাকলেও তার মনে ছিল না কোনো ক্লান্তি, বরং এক ধরনের শান্তি খুঁজে পেতেন পরিবারের হাসিমুখ দেখে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা তার শান্ত জীবনের সব কিছুকে এক মুহূর্তে উলটপালট করে দিল। একদিন, অপ্রত্যাশিতভাবে শহীদ হয়ে যান পারভেজ। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। এখন পরিবারে ইনকাম করার মত কোন পুরুষ সদস্য অবশিষ্ট নাই। এখন তারা চিন্তিত, কিভাবে চলবেন এবং কিভাবে সংসারের খরচ চালাবেন। পারভেজের অভাব তাদের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সংসার কীভাবে চলবে, কীভাবে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জুটবে—কিছুই বুঝতে পারছেন না পরিবারটি।প্রতিবেশীরা জানান, টিনের একটি বসতঘর ছাড়া পরিবারটির আর কোনো জমিজমা নেই। এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য কাজী মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, পরিবারটি এখন খুবই অসহায়। তাদের পাশে সরকার ও বিত্তবানদের দাঁড়ানো উচিত। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি শহিদ পারভেজ বেপারী শৈশবকাল থেকেই ছিলেন সচেতন ও প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এবং সদালাপী মানুষ ছিলেন। ছোটবড় সকলের সাথে মিলেমিশে চলতেন।তিনি পিতামাতার বাধ্যগত সন্তান ছিলেন। সকল সময় সে তার পিতামাতাকে নিয়ে ভাবতেন। তিনি তার ছোট তিন বোনকে অনেক স্নেহ করতেন। মা শামসুন নাহার বেগম বলেন, “নিরীহ ছেলেডা পুলিশের গুলিতে মরল, এহন আমার সংসার চালাইবো কে? আমার তিন মাইয়ার লেহাপড়ার খরচ কে দিবো? ছেলেডার লাশটাও দেখতে পারলাম না, এই দুঃখ কীভাবে ভুলি? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ এইসব কথা বলতে গিয়ে কোনোভাবেই কান্না চেপে রাখতে পারছিলেন না তার মাতা শামসুন্নাহার বেগম। শিশুর মতো অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। পারভেজের বোন নূপুর জানান, গত ১৭ জুলাই পারভেজের সঙ্গে মুঠোফোনে তাদের সর্বশেষ কথা হয়। কী কথা হয়েছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা কেমন আছেন, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করা হয় কি না, জানতে চান পারভেজ। মাকেও শরীরের যত্ন নিতে বলেছিলেন। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আক্ষেপ করে নূপুর বলেন, ‘ভাইয়ের লাশ একটু দেখতে পেলেও শান্তি পেতাম; কিন্তু তা-ও হয়নি।’ কথাগুলো বলার সময়ই গলা ধরে আসছিল নূপুরের। একসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, ‘এখনো মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার ভাই মরে নাই। শুক্রবার আইলেই মনে অয়, এই বুঝি ভাই ঢাকা থেকে ফোন করবে।’ নূপুরের কান্না দেখে চোখের পানি আটকাতে পারলেন না পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই বোন ঝুমুর ও খাদিজা। এই কান্না যেন সংক্রমিত হয়ে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল পারভেজের মা-বাবা ও প্রতিবেশীদের চোখে-মুখেও। ঘটনার প্রেক্ষাপট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছিল জুলাই’২৪ জুড়ে। ছাত্ররা মূলত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা এবং সেমিনারের মাধ্যমে তাদের দাবি তুলে ধরেছে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলনটি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা যায়, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী ও ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কারণ স্বৈরাচার সরকার ছাত্রদের নায্য দাবী না মেনে চালাচ্ছিলো অত্যাচারের স্টীমরোলার। সারাদেশ জুড়ে গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোঁড়া হচ্ছিলো ছাত্রজনতাকে লক্ষ্য করে। খালি হয়ে যাচ্ছিলো হাজারো মায়ের বুক, পিতাহারা হয়ে পড়ছিলো হাজারো শিশু একইসাথে স্বামী হারা হচ্ছিলো হাজারো রমণী। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের 'কমপ্লিট শাটডাউন' বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়। পুলিশ ও বিজিবির নৃশংস গুলিতে ১১৯ জন শাহদাতবরণ করেন। এরপরপরই ছাত্র আন্দোলন রুপ নেয় গণআন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। এদিন রাস্তায় ছাত্রদের চাইতেও বেশি ছিল নানান শ্রেণির, নানান পেশার মানুষ যাদের একটাই দাবী ছিল স্বৈরাচার হটানো। বলাবাহুল্য সারাদেশের চেয়ে রাজধানী ঢাকা ছিল বেশি অগ্নিগর্ভ, যেখানে এইদিনে শহীদ হয়েছিল শত মানুষ। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরা-বাড্ডা, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর ১ ও ১০, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, সাভার ছিল আন্দোলনের মূল হটস্পট। এদিন রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।একইসাথে বিচ্ছিন্ন করা হয় সকল ইন্টারনেট সেবা। ফলে তথ্যহীনতায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সারাদেশ। এই রক্তক্ষয়ী ১৯ জুলাই পিতামাতার কোল খালি করে শহিদ হন পারভেজ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ১৯ জুলাই রাত ১০টায় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন পারভেজ। সেখান থেকে তাঁর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যান স্থানীয় লোকজন। পরে মরদেহটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মীরা ঢাকার কাকরাইল কিংবা মুগদা এলাকার কবরস্থানে দাফন করেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় কবরটিকে এ পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেননি স্বজনেরা। পারভেজের মাতা শামসুন্নাহার বেগম বলেন, দুইদিন পারভেজের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। পরে তার পরিচিত একজন ফোন দিয়ে বলে, পারভেজ গুলি খেয়েছে এবং শহিদের র্মযাদা লাভ করছে।এরই জের ধরে পারভেজের পিতা সবুজ বেপারী গত ২২ জুলাই ঢাকা মেডিকেলের মর্গে যান এবং মৃত মানুষের তালিকায় পারভেজের নাম দেখেন। তাঁর মৃত্যুতে সারা এলাকায় এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ পারভেজ শুধু একজন যুবক ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। গত ১৬ বছর ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলা স্বৈরাচারী শাসন, ভোটের অধিকার হরণ, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম, খুন, গুম—এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক সৈনিক। তার মতো সাহসী মানুষের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকেই নয়, একটি পুরো সমাজকেই শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। আজ পারভেজ নেই, কিন্তু তার প্রতিবাদী চেতনা, তার আত্মত্যাগ, তার শহীদ হওয়ার বেদনা যেন সবকিছুই থেকে যায় তার পরিবারের চোখের জলে, এলাকার মানুষের হৃদয়ে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এই দোয়াই আজ সকলের মুখে। তাইতো কবির ভাষায়, দুঃখরা কেন এভাবে মিছিল করে আসে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবনের স্পন্দন থামিয়ে দিয়ে ? দুঃখরা কেন বার বার ওদেরকেই ভালোবাসে ওদের হাসি-কান্নায় ভরপুর জীবনকে স্তব্ধতায় ঢেকে দিয়ে ? এক নজরে শহীদ পারভেজ বেপারী নাম : পারভেজ বেপারী পেশা : কাঠমিস্ত্রী জন্ম তারিখ ও বয়স : ০১-০১-২০০১ আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪ জুমাবার, সন্ধ্যা ৭ টা শাহাদাত বরণের স্থান : জানা নাই দাফন করা হয় : জানা যায়নি। আনজুমানে মফিদুল ইসলাম লাশ দাফন করে কবরের জিপিএস লোকেশন: কবরের স্থান জানা নাই স্থায়ী ঠিকানা : বারহাতিয়া, ফতেহপুর পূর্ব , মতলব উত্তর, চাঁদপুর পিতা : মোঃ সবুজ বেপারী মাতা : শামসুন্নাহার বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা: গ্রামে অল্প জমি আছে। একটি ভিটা জমি আছে ভাই বোনের বিবরণ : তিন বোন। ভাই নাই। বোনদের সবাই পড়াশোনা করে বড় বোন : নুপুর আক্তার (বয়স, ২১ এইস এস সি পাশ) মেজো বোন : ঝুমুর আক্তার(বয়স ১৬, শ্রেণি: দশম) ছোট বোন : খাদিজা আক্তার (বয়স ১২, শ্রেণি: ষষ্ঠ) শহীদ পরিবারকে সাহায্যের প্রস্তাবনা প্রস্তাবনা-১ : বাবার জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে প্রস্তাবনা-২ : ছোট বোনদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে প্রস্তাবনা-৩ : মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

আওয়াল মিয়া

মো: মাহমুদুল হাসান রিজভী

মো: কামরুল মিয়া

মহিন উদ্দিন

মো: ইফাত হাসান খন্দকার

মাসুম মিয়া

মো:  সিয়াম সরদার (জিহাদ)

মো: আবু বকর ছিদ্দিক

মো: ইয়াছিন

মো: রায়হান

মো: শাহাদাত হোসেন শাওন

আবদুল কাইয়ুম

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo