জন্ম তারিখ: ২৫ জুলাই, ২০০৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৫ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ছাত্রী, মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজ শাহাদাতের স্থান: উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, ঢাকা
শহীদ পরিচিতি সুজলা সুফলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মিলনস্থল চাঁদপুর জেলা। চারিদিকে সবুজের সমারোহে ঘেরা মতলব উত্তর থানার সুলতানাবাদ ইউনিয়নের আমুয়াকান্দা গ্রামে ২৫ জুলাই ২০০৯ সালে গোলাম মোস্তাফা ও আইনুন নাহারের পরিবার আলোকিত করে দুনিয়াতে আসেন শহীদ নাঈমা সুলতানা। বাবা গোলাম মোস্তফা পেশায় একজন জনপ্রিয় হোমিও চিকিৎসক। তিনি চাঁদপুর মতলব দক্ষিণ নারায়ণপুর বাজারে নিয়মিত রোগীদের সেবা দিয়ে থাকেন। মা একজন আদর্শ গৃহিণী। তিনি তার সন্তানদের নিয়ে তাদের পড়াশোনার সুবিধার্থে উত্তরা ৯ নং সেক্টরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। আদরের মেয়েকে হারিয়ে এখন শোকে মূহ্যমান তিনি। তীক্ষ্ণ মেধাবী শহীদ নাঈমা শহীদ নাঈমা সুলতানা ছোট বেলা থেকে তীক্ষ্ণ মেধাবী ছিল। বাল্যকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় মেধার স্বাক্ষর রেখেছিল সে। শিক্ষক ও সহপাঠীরা তার মেধার উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন। নাঈমার পড়ালেখার হাতে খড়ি হয় নিজ গ্রামেই। সে ২০১৯ সালে ১৫৫, নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৫ অর্জন করে প্রথমবারের মত মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করে । এরপর ভর্তি হয় আলহাজ্ব তোফাজ্বল হোসেন ঢালী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে সে বরাবরের মত প্রথম স্থান অধিকার করে মেধার স্বাক্ষর রাখে। গ্রাম থেকে ৭ম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে ২০২২ সালে এক বুক স্বপ্ন ধারণ করে মায়ের সাথে পাড়ি জমান ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকার স্বনামধন্য মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে। ২০২২ সালে সরকার করোনা মহামারির কারণে জেএসসি পরীক্ষা নেয়নি। ২০২৩ সালে নাঈমারা অটো নবম শ্রেণিতে উন্নিত হয়। শাহাাদাত বরণের আগ পর্যন্ত সে এই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন মাটি করে দিল পুলিশ কিশোরী মেধাবী শহীদ নাঈমা সুলতানার স্বপ্ন ছিল পাহাড়সম। বড় হয়ে দেশের মানুষের সেবা করার ব্রতী ছিল সবসময়। তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একজন মানবিক ডাক্তার হবে আর অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। এই অনুপ্রেরণা সে মূলত তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল। সে ছোট বেলা থেকে তার বাবার মানুষকে সেবা করার দৃশ্য দেখেছে। কিন্তু পুলিশ বুলেটের আঘাতে তার সেই স্বপ্ন মাটি করে দিল। তার বাবা কান্না করতে করতে বলেন, “আমার স্বপ্ন ছিল আমার মেয়েকে ডাক্তার বানাবো। সে দেশের মানুষের সেবা করবে। কিন্তু এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো?” যেভাবে শহীদ হলেন নাঈমা সুলতানা আওয়ামী পৈশাচিক সরকার ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এ দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাথে অঘোষিতভাবে যুদ্ধে নেমে পড়ে। পুলিশের পেটোয়া বাহিনী ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন দমানোর জন্য কোন ধরণের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। পুলিশেরে গুলি থেকে রেহায় পায়নি পথচারী, দোকানদার, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, হকার, এমনকি মায়ের কোলের শিশুও। এই নারকীয় হত্যাকান্ডের বলি হন মাইলস্টোন স্কুলের মেধাবী ছাত্রী শহীদ নাঈমা সুলতানা। ১৯ জুলাই ২০২৪ সাল। দিনটি জুমাবার। ছাত্র জনতার দ্বিতীয় দিনের মত কমপ্লিট শাট ডাউন চলছিল। সরকার সারা দেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট করে পৃথিবী থেকে পুরো বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে ছাত্র জনতার উপর হামলা চালায়। উত্তরায় জুমার নামাজের পর ছাত্র জনতা মিছিল বের করলে মিছিলে পুলিশ সরাসরি গুলি চালায় । ঘটনাস্থলেই প্রাণ যায় অনেকের। আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের অলিতে গলিতে ঢুকে পড়ে। উত্তরা ৯ নং সেক্টরের ৫ নং রোডে ১৫ নং বাসায় থাকে শহীদ নাঈমা সুলতানার পরিবার। নাঈমা তখন বাসায় বিশ্রাম করছিল। বাইরে হট্টগোল শুনে বেলকনিতে আসে দেখার জন্য। নিজ চোখে দেখতে পেল পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি করার দৃশ্য। তখনো সে কল্পনাই করতে পারেনি যে, কয়েক সেকেন্ড পরেই পুলিশের বুলেট তার কপাল বিদ্ধ করবে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই একটি গুলি এসে লাগলো তার মাথায়। বেলকনিতে লুটিয়ে পড়ে সে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তার এই অবস্থা দেখে হতবিহ্ববল হয়ে পড়ে। রক্তে লাল হয়ে উঠলো বেলকনির সাদা টাইলস। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে যায় উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে। নেওয়া হলো আইসিইউতে। কিছূক্ষণ পরেই খবর এলো মেধাবী ছাত্রী নাঈমা সুলতানা শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন। চিকিৎসকরা তাকে একটি জাতীয় পতাকায় মুড়িয়ে দিলেন আর বললেন শহীদ নাঈমা আমাদের প্রেরণা। আমরা নাঈমা সুলতানার কাছে চিরঋণী হয়ে রইবো। লাশ বাড়িতে নিতে নাটকিয়তা লাশ বাড়িতে নিতে বাধে বিপত্তি। কোন এ্যাম্বুলেন্সকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে যেতে দেয় না খুনি হাসিনার ক্যাডার বাহিনী। শহীদ নাঈমার লাশ পতাকা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। বারবার হাসিনার পেটুয়া বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকে শহীদ পিতা ও তাঁর পরিবার। একপর্যায়ে কোন উপায় না পেয়ে শহীদের চাচা নিজেকে মুমূর্ষু রোগী সাজিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে উত্তরার পথে রওনা করেন। রাস্তায় কয়েকবার ঘাতকদের রোষানলে পড়েন তিনি। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে ধড়ফড় করে বুঝান তিনি শারীরিক ভাবে ভীষণ অসুস্থ। অতঃপর অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে শহীদের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে। খুনি হাসিনার বর্বরতার আসলে শেষ কোথায়! সামান্য মতের অমিল হলে, ভিন্নমতাবলম্বী হলে, অভিযুক্ত মানুষটিকে সুযোগ পেলেই এই পিশাচ পেটুয়া বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে। এ যেন মানুষ রূপি রক্ত খেকো হায়েনার চেয়েও হিংস্র। আন্দোলনের অগ্র সেনানী শহীদ নাঈমা সুলতানা আন্দোলনের অগ্রসেনানী ছিল শহীদ নাঈমা সুলতানা। ছাত্রদের অধিকার আদায়ে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে সে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতো। শাহাদাত বরণের আগের দিনও সহপাঠীদের সাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে । সে ছিল অংকনশিল্পী । তার অংকনের হাত ছিল অনেক সমৃদ্ধ । ডায়েরীতে সে আন্দোলনের দাবী দাওয়া নিয়ে একটি পোস্টার আঁকে যেখানে লেখা ছিল, চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন স্লোগান। সে এই পোস্টার তার ফেসবুক ওয়ালে দিয়ে সেখানে লিখে- আন্দোলন হবে এবার রংতুলিতে। কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক। ১৮ জুলাই আন্দোলন থেকে ফিরে সে তার মাকে বলেছিল, “আম্মু আমি শহীদ হলে তুমি কান্না করিওনা। শুধু আলহামদুলিল্লাহ বলিও।” নাঈমা সুলতানা ঠিকই শাহাদাত বরণ করেছেন, কিন্তু ,মা তার কথা রাখতে পারেননি। মা আইনুন নাহার আজও প্রতিনিয়ত তার মেয়ের জন্য কান্না করছে, তার আর্তনাদ যেন থামছেইনা। কেমন আছে নাঈমার পরিবার নাঈমারা দুই বোন এক ভাই। সে দুনিয়াতে আসার পর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল তার বড় বোন তাসফিয়া। কারণ সে অনেকদিন পর তার একজন খেলার সাথী পেয়েছিল। এখন একমাত্র বোনকে হারিয়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সে এখন খাবার টেবিলে, পড়ার টেবিলে সবসময় নাঈমাকে মিস করে। একমাত্র ভাই আব্দুর রহমান এর বয়স এখন নয় বছর । সে তার বোনের রক্তমাখা কফিন দেখেছে। তার মাঝে এক ধরণের ভয় ও আতংক কাজ করছে এখনো। একমাত্র ভাই হিসেবে তাকে খুবই আদর করতো নাঈমা। নাঈমাকে তার মনে পড়ে খুব। মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে সেও কান্না করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। বড় বোন তাসফিয়া বলেন, “আমার ছোট বোন হলেও সে আমার বন্ধুর মত ছিল। আমরা মিলেমিশে থাকতাম খুব। মাঝেমধ্যে ঝগড়া দিতাম। একসাথে বাইরে ঘুরতে যেতাম। এখন সবকিছুতেই তাকে মিস করছি। কেন পুলিশ আামার বোনকে আমাদের মাঝ থেকে কেড়ে নিল? আমি এর বিচার আল্লাহকে দিলাম।” ক্লাসে নাই নাঈমা নাঈমা এখন আর ক্লাসে যায়না। আর কোনদিন তাকে ক্লাসে দেখা যাবেনা। দেখা যাবেনা এসেম্বলিতেও। সহপাঠীদের সাথে প্র্যাক্টিকেল ক্লাসে বা করিডোরে দেখা হবেনা আর। রঙতুলিতে আঁকবেনা আর মুক্তির স্লোগান। তার হাতে অঙ্কিত হবেনা বৈষম্য বিরোধী দৃশ্যপট। মুক্তির আন্দোলনে লড়াকু অবস্থান চোখে পড়বেনা আর। তার সহপাঠীদের চোখে মুখে কষ্টের ছোঁয়া। প্রিয় বন্ধুর জন্য তাদের মন কাঁদে খুব। এইতো অল্প কিছুদিন আগেও ক্লাসে ছিল সে, অথচ আজ নাই । আওয়ামী হায়েনার দল বন্ধুদের মাঝ থেকে তাকে কেড়ে নিল। শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত তাকে স্মরণ করছে আর তার জন্য দোয়া করছে, আল্লাহ তায়ালা যেন শহীদ নাঈমা সুলতানাকে জান্নাতবাসী করেন। এক নজরে শহীদ নাঈমা সুলতানা নাম : নাঈমা সুলতানা পেশা : ছাত্রী জন্ম তারিখ ও বয়স : ২৫ জুলাই ২০০৯, ১৫ বছর আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, জুমাবার, আনুমানিক বিকেল ৩.৪০ টা শাহাদাত বরণের স্থান : উত্তরা আধুনিক হসপিটাল দাফন করা হয় : দেওয়াবাড়ী, আমুয়াকান্দা, সুলতানাবাদ, মতলব উত্তর, চাঁদপুর কবরের জিপিএস লোকেশন : ২৩ক্ক২৩'২৪.৬"ঘ ৯০ক্ক৪৪'২৮.৪"ঊ স্থায়ী ঠিকানা : দেওয়াবাড়ী, আমুয়াকান্দা, সুলতানাবাদ, মতলব উত্তর, চাঁদপুর পিতা : গোলাম মোস্তাফা দেওয়ান মাতা : আইনুন নাহার ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : অল্প জমি আছে। একটি সেমিপাকা বাড়ি আছে ভাইবোনের বিবরণ : একবোন এইবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। একমাত্র ভাই ২য় শ্রেণীতে পড়ে প্রস্তাবনা ১. শহীদ ভাই বোনের লেখা পড়ার দায়িত্ব নেয়া যেতে পারে ২. পরিবারে মাসিক সহযোগিতা করা যেতে পারে