জন্ম তারিখ: ২৯ নভেম্বর, ১৯৮৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: গার্মেন্টস কর্মী শাহদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
শহীদ শাহ আলম কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলাধীন জয়পুর ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রেনু মিয়া ও মাতা সাফিয়া বেগমের কোল জুড়ে ১৯৮৩ সালের ২৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ছোট্ট থাকতেই তিনি এবং তার সহদোর ভাইদের নিয়ে তাঁদের পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় তার বাবা বিভিন্ন কাজ করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। কখনো দিনমজুরি, কখনো ফুটপাতে ক্ষুদ্র কোনো ব্যবসা, কখনো কারও প্রতিষ্ঠান দেখাশোনার কাজ, এভাবেই দিন চলতো তাদের। তাই শহীদ শাহ আলমের শৈশবের অনেকটাই কেটেছে রাজধানী ঢাকায়। প্রথম দিকে তিনি স্বপরিবারে বাড্ডা এলাকায় থাকতেন। সেখানেই বাড্ডা আদর্শ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তীতে শহীদের পরিবার আবার নিজ জেলা কুমিল্লায় ফিরে গেলে বহু ইচ্ছা থাকা সত্বেও আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। এরপর ঢাকাতেই বিভিন্ন কাজে শাহ আলমের বীরত্বের সেদিন সারা দেশে তখন চলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচি 'কমপ্লিট শাটডাউন' বা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। সেদিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরুল বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ ও পুলিশের মাঝে কয়েকদফা সংঘর্ষ হয়েছে। সারা দেশে ছাত্রদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচী আর ১৬ জুলাই পরবর্তী শহীদ আবু সাইদ, শহীদ ফয়সাল মাহমুদ শান্তসহ দেশের অসংখ্য নিরীহ ছাত-জনতাকে হত্যার প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সেদিন সকাল সাড়ে ১০টার সময় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। শান্তিপূর্ণ সে আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে দিতে, প্রথমেই ওই এলাকায় গিয়ে একের পর এক টিয়ারশেল আর রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে থাকে স্বৈরাচার সরকারের পেটোয়া পুলিশ। পরে উত্তেজিত ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় পুলিশ। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রামপুরা ব্রিজ এলাকায় তখনও আন্দোলন করছিলো সাধারণ ছাত্ররা। কিছুক্ষণ পর বিটিভি ভবনের সামনে অস্ত্র হাতে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ এবং আওয়ামীলীগ কর্মীরা জড়ো হতে থাকে। এক পর্যায়ে বেলা ১১টার পর তারা বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। এসময় শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে পুরো এলাকা সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এভাবেই সেদিন স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ আর যুবলীগের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থী আর জনতার। শিক্ষার্থীদের ওপরে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ-যুবলীগ আর নিষ্ঠুর পুলিশের এমন আক্রমণ কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না শাহ আলম। যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করা নিরিহ শিক্ষার্থীদের ওপর এমন বর্বরোচিত হামলা দেখে হয়তো শাহ আলমের মনে পড়ে গিয়েছিলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা 'ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা' এর সেই বিখ্যাত চরণ গুলো, “ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা, ভাঙিয়া পড়ো না দুখে, পাতালের এই মাতাল রবে না আর পৃথিবীর বুকে। তখতে তাহার কালি পড়িয়াছে অবিচারে আর পাপে, তলোয়ারে তার মরিচা ধরেছে নির্যাতিতের শাপে।” তাই একপর্যায়ে প্রতিরোধে সামিল হন তিনি নিজেও। অতঃপর আন্দোলন স্থলে দ্বিতীয়বার ফিরে আসে ঘাতক পুলিশ, এবার কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভবন থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী-জনতার ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে তারা। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সাথে শাহ আলমের মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষ গিয়ে প্রতিরোধ শুরু করলে, ওই ভবনেই আটকে পড়ে পুলিশ সদস্যরা। তারপর সংঘর্ষস্থলে আসে বিজিবির কয়েক প্লাটুন সদস্য, তারাও এসে নিরীহ ছাত্র জনতার ওপর একে-৪৭, টাইপ ৫৬ কারবাইন আর অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। একপর্যায়ে ঘাতকের ছোঁড়া গুলি এসে লাগে শাহ আলমের বুকে আর মুহূর্তেই বুক ভেদ করে মেরুদন্ডের পাশে আটকে পড়ে সেটি। উঠে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে শাহ আলম। তার সাথে আন্দোলনরত কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী বহুকষ্টে ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাথে সাথে শুরু হয় অপারেশন, দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার অপারেশনের পর গুলিটি বের করেন মেডিকেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকবৃন্দ। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা শাহ আলম আর দায়সারা চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর, একটি অপারেশনের মাধ্যমে তার দেহ থেকে বের করা হয় ঘাতকের ছোঁড়া গুলি। তবে ততক্ষণে ঘাতক বুলেট ফুসফুস আর বুক ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল শাহ আলমের, এমন তীব্র যন্ত্রণা সত্বেও অস্ত্রোপচারের তারিখ বারবার পিছিয়েছে। প্রথম অস্ত্রপ্রচারের পর জ্ঞান ফিরলে শাহ আলম বারবার বুকে আর মেরুদন্ডে যন্ত্রণার কথা জানাচ্ছিলেন। এবার কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাস চালানোর জন্য ফুসফুসের আরেকটি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকবৃন্দ। প্রথমে ১ আগস্ট অপারেশনের দিন নির্ধারণ করা হলেও, নানা কারণে বারবার পেছাতে থাকে অস্ত্রোপচারের দিন। ৩ আর ৪ আগস্ট অস্ত্রোপচারের দ্বিতীয় দফার তারিখ নির্ধারণ করা হলেও, আবারো তারিখ পেছানো হয়। অবশেষে শাহ আলমের স্ত্রী শিল্পী বেগমের কাকুতিমিনতিতে ৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফার অপারেশন করা হয়। তবে তারপর থেকেই অবস্থা খারাপ হতে থাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী শাহ আলমের। অপারেশন পরবর্তী রোগীর সার্বিক অবস্থার রিপোর্ট, শাহ আলমের পরিবার নিজ দায়িত্বে ঢাকা মেডিকেলের একজন সিনিয়র সার্জনের কাছে নিয়ে গেলে, তিনি জানান, “অপারেশন পরবর্তী রোগীর অবস্থা আরো কিছুটা অবনতি হয়েছে। ফুসফুসের অবস্থা অনুযায়ী, তার অস্ত্রোপচার হয়নি।” অবশেষে, দীর্ঘ ২৬ দিন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার পর ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার রাত ৩ ঘটিকায় জীবনের সফর শেষ করেন শাহ আলম। “শেষ হলো তার জীবন সফর, নশ্বর পৃথিবীর অমর হয়ে রইলেন নব স্বাধীনতার বীর।” জানাজা ও দাফন পরবর্তীতে শহীদের মরদেহ নিজ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জনাজা শেষে অন্তরপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। শহীদ শাহ আলমের চিকিৎসা নিয়ে আক্ষেপ রয়ে গেল শহীদ মো: শাহ আলমের স্ত্রী মোসা: শিল্পী বেগম অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে জানালেন, তার স্বামীর চিকিৎসায় অবহেলা আর ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ সারাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনার কথা। তিনি বলেন, “আমার স্বামীকে ১৮ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করার পর, রাত ৮টায় তার কাছে থাকা মুঠোফোন থেকে নম্বর সংগ্রহ করে জানানো হলো আমাদের। দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার পর, রাত ১২টায় অপারেশনের মাধ্যমে তার শরীর থেকে গুলি বের করা হলো। তবে, জ্ঞান ফেরার পর তিনি বুকে আর মেরুদণ্ডে তীব্র ব্যথার কথা জানাচ্ছিলেন। পরে, ৫ তারিখে আরেকটি অপারেশনের পর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিলেন তিনি। আমরা তার অপারেশন পরবর্তী রিপোর্ট অভিজ্ঞ একজন চিকিৎসককে দেখালে, তিনি বলেন অপারেশন আশানুরূপ হয়নি। এর মধ্যে হাসপাতালে নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়েছি আমরা। আমাদের প্রথমে আইসিইউতে বেড দিতে গড়িমসি করছিলো, মেডিকেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরে আমার ভাই, নানা জায়গায় তদবির করলে বার্ন ইউনিটে একটি বেডে স্থানান্তরিত করা হয় তাকে।" আমরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম চিকিৎসায় সরকার ঘোষিত সহযোগিতার কতটুকু পেয়েছিলেন তারা। উত্তরে তিনি বেশ রাগান্বিত আর হতাশা নিয়ে বললেন, “তেমন কোন সহযোগিতাই পাইনি আমরা। ২৬ দিন মেডিকেলে থাকা আর ঔষধ বাবদ আমাদের প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়, যার পুরোটাই আমাদের বহন করতে হয়েছে।” শহীদ পরিবারের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ শাহ আলমের অবর্তমানে পরিবার নিয়ে বেশ দুর্দশায় পড়েছেন স্ত্রী শিল্পী বেগম। পূর্বে তার উপার্জিত অর্থ দিয়েই পরিবার চলত তাদের। তাই এখন পিতৃহীন তিন সন্তান আর আগামী দিন নিয়ে বেশ চিন্তিত তিনি। শহীদের স্ত্রী জানান, “প্রথমে আমার বড় ভাইয়ের থেকে ধার নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি আমার স্বামীর। পরবর্তীতে বাসা-ভাড়া, ছেলে মেয়ের স্কুলের বেতন নিয়ে আবারও দিশেহারা হয়ে পড়ি। এরমধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ১ লক্ষ টাকার অনুদান পেয়ে, তা থেকেই বাসা ভাড়ার ১২ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধ করি। আর বাকি টাকাগুলো এখন দৈনন্দিন চাহিদা অনুসারে খরচ করছি, জানি না এভাবে কতদিন চলবে।” এরই মধ্যে রামপুরা এলাকায় ভাড়া নেওয়া বাসা ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। অসহায় তিন সন্তানকে নিয়ে এখন উত্তর বাড্ডার ২৫ নম্বর লেনের বাবার বাড়িতেই হবে তার পরবর্তী ঠিকানা। রামপুরার বাসার সাথে ছাড়তে হচ্ছে, শহীদের তিন এতিম সন্তানের বিদ্যালয়ও। আবার গ্রামে অসহায় মা-বাবাকেও নিয়মিত আর্থিক সহায়তা করতো শাহ আলম। তাই পুত্রকে হারিয়ে দিশেহারা তার সবজি বিক্রেতা বাবা রেনু মিয়া আর গৃহিনী মা সাফিয়া বেগম। প্রস্তাবনা ১: শহীদের পরিবারের এতিম তিন শিশু ও তার অসহায় স্ত্রীর জন্য স্থায়ী আয়ের কোনো ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। ২: শহীদের দরিদ্র সবজি বিক্রেতা পিতা আর বৃদ্ধা মাকেও আর্থিক সহায়তা করা দরকার। নিয়োজিত ছিলেন। জীবনের বিরাট একটা সময় পোশাক কারখানায় কাজ করেছেন। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন রামপুরা এলাকার জান গার্মেন্টসে। একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্য শহীদের পূর্ণনাম : শাহ আলম জন্ম তারিখ : ২৯ নভেম্বর ১৯৮৩ পেশা : গার্মেন্টস কর্মী পিতার নাম : রেনু মিয়া পিতার পেশা ও বয়স : ভ্যানে কাচামালের ব্যাবসা, ৬৫ বছর মাতার নাম : সাফিয়া বেগম মাতার পেশা ও বয়স : গৃহিণী, ৬০ বছর স্ত্রীর নাম : শিল্পী বেগম স্ত্রীর পেশা ও বয়স : গৃহিণী, ৩২ বছর পরিবারের মাসিক আয় : কোনো আয় নেই পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা : ৬ জন সন্তানদের নাম, বয়স ও প্রতিষ্ঠান: ১) মো: সাব্বির (১৫), আল ফোরকান হাই স্কুলের ৯ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ২) মো: ইয়ামিন (১১), আল ফোরকান হাই স্কুলের ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ৩) মোছা: ফাহমিদা (০২), আল ফোরকান হাই স্কুলের ২য় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত আহত হওয়ার স্থান : রামপুরা ব্রীজের কাছে, ঢাকা আহত হওয়ার সময়কাল : বিকাল আনুমানিক ৫টা নিহত হওয়ার স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিহত হওয়ার সময়কাল : ১৩ আগস্ট ২০২৪, রাত: ৩টা শহীদের কবরের অবস্থান : অন্তরপুর কবরস্থান, জয়পুর, কুমিল্লা ঠিকানা সংক্রান্ত তথ্য স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: অনন্তপুর, ইউনিয়ন: জয়পুর, উপজেলা: হোমনা, জেলা: কুমিল্লা বর্তমান ঠিকানা : রোড নম্বর: ২৫, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা।