জন্ম তারিখ: ২১ জানুয়ারি, ১৯৯৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : টাইলস মিস্ত্রি, শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী
শহীদ মো: তুহিন আহমেদ, চব্বিশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের এক অকুতোভয় যোদ্ধা, ১৯৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুর উপজেলার সোনারামপুর গ্রামের পবিত্র মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কাটিয়েছেন একান্ত সরলতায়, মায়ের আদরে ও বাবার স্নেহের আভাসে। তার বাবা ছগির আহমেদ ছিলেন এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যিনি কঠোর পরিশ্রমে জীবনযাপন করতেন, আর মা তাহমিনা বেগম ছিলেন সংসারের আলো, একজন নিবেদিতপ্রাণ গৃহিণী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তুহিন ছিলেন সকলের বড়, তার মধ্যেই যেনো পরিবারের দায়িত্ববোধ ও সংগ্রামের প্রতিফলন স্পষ্ট ছিল। যদিও তার শিক্ষাজীবন ছিল সীমিত, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তবুও তা কখনও তার মননশীলতা কিংবা সংগ্রামী চেতনার প্রতিবন্ধক হতে পারেনি। পারিবারিক বাধ্যবাধকতা তাকে বিদ্যালয় থেকে দূরে নিয়ে গেলেও, তিনি জীবন সংগ্রামের ময়দানে অসীম সাহসিকতায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। টাইলস মিস্ত্রির কাজ করতেন এক কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে, তবুও মনের গভীরে ছিল এক আকাশজোড়া স্বপ্ন আর স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তার চার বছরের এক পুত্রসন্তান রয়েছে, যার শৈশব পিতার স্নেহহীনতায় কাটছে, কিন্তু পিতার গৌরবময় আত্মত্যাগের ছায়ায় সে একদিন বড় হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ মো: তুহিন আহমেদ ছিলেন একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। যার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। তার বাবা একসময় মালয়েশিয়ায় কাজ করতেন। কিন্তু এখন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বসবাস করেন, যেখানে এক সময় ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে বর্তমানে কোনো কাজ করেন না। এই অবস্থার ফলে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে উঠেছে। তুহিনের গ্রামে মাত্র একটি অল্প ভিটা জমি এবং তার উপর একটি ছোট্ট টিনের বাড়ি ছাড়া আর কোনো স্থায়ী সম্পদ নেই। পরিবারটি এই ভিটা জমির ওপরই টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে যথেষ্ট সুরক্ষা নেই। শহীদ তুহিন আহমেদ একজন বিবাহিত ব্যক্তি ছিলেন এবং তার একটি চার বছরের সন্তান রয়েছে। বাবার অভাবের ভেতর এই সন্তান এখন ভবিষ্যতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। তুহিন আহমেদের মৃত্যু তাদের পরিবারের জন্য শুধু একজন প্রিয়জনের হারানো নয়, বরং তা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে। তারা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে, জীবনের প্রতিটি দিন যেন একটি নতুন যুদ্ধের সূচনা। যেভাবে শহীদ হলেন ২০ জুলাই ২০২৪ সাল। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। যেদিন স্বৈরাচারী সরকার সাধারণ জনতার রক্তে হাত রাঙালো। ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন ছিল ন্যায্যতার জন্য ছাত্রসমাজের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত লড়াই, যা ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলনের রূপ নেয়। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল চাকরির নিয়োগে স্বচ্ছতা এবং বৈষম্যহীন কোটা সংস্কার। কিন্তু ক্ষমতাসীন হাসিনা সরকার এই আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে এক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে, যা ইতিহাসে চিরকাল কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক গণতন্ত্রবিরোধী কাজ শুরু করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও গুম, মিডিয়ার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, এবং তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন ভাঙার পাঁয়তারা—এসব ছিল তার শাসনের নিয়মিত কুকর্ম। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তার সরকার ইন্টারনেট শাট ডাউন করে জনমত দমন করার ঘৃণ্য পন্থা নেয়। সেদিন যাত্রাবাড়ীর মিছিলে মো: তুহিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন, তিনি প্রতিদিনের মতো নিজের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশ নেন। কিন্তু সেদিনের পরিবেশ ছিল অন্যরকম। পুলিশ ও র্যাব আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে ছাত্র জনতার ওপর উপর্যুপরি গুলি চালায়। হাসিনার স্বৈরাচারী বাহিনী সেদিন স্থল অভিযানের পাশাপাশি আকাশ থেকেও হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি বর্ষণ করে। আকাশ থেকে র্যাবের ছোড়া গুলি মো: তুহিনের শরীরে বিদ্ধ হয়। আর তার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তুহিনকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা থাকায় সহযোদ্ধারা তাকে এনাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে অস্ত্রোপচার করা হলেও তুহিনের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। অবশেষে দু’দিন পর, আইসিইউতে তার জীবনাবসান ঘটে। মো: তুহিনের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত শোক নয়, এটি ছিল একটি জাতির স্বপ্নকে হত্যা করার প্রচেষ্টা। ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন, যা ন্যায়বিচার ও সমতার দাবিতে গড়ে উঠেছিল, সেটিকে নির্মমভাবে দমন করা হয়। হাসিনা সরকারের এই নির্মমতা নতুন কিছু নয়। তার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী মত দমনের ইতিহাস দীর্ঘ। তিনি বারবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। কোটা আন্দোলনের তরুণরা যখন ন্যায়ের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল, তখন তাদের ওপর এমন অত্যাচার চালানো হয়, যা শুধু দেশের নয়, পুরো বিশ্বের সামনে সরকারের বর্বর রূপটি প্রকাশ করে। মো: তুহিন আহমেদের আত্মত্যাগ আজ ইতিহাসের পাতা ভরিয়ে রেখেছে। তিনি কেবল নিজের জন্য নয়, সারা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য জীবন দিয়েছেন, যারা একটি ন্যায্য, সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজ চায়। তার রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা রয়ে গেছে। নির্মমতার স্বীকার শহীদ মো: তুহিন মো: তুহিনের শাহাদাতের পরবর্তী ঘটনাগুলো অত্যন্ত নির্মম এবং পাষবিকতার চূড়ান্ত রূপকে তুলে ধরে। একদিকে তার শোকাহত পরিবার ও এলাকাবাসী তাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অন্যদিকে সরকারী পেটুয়া বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের বাধা তাদের সেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। বন্ধুবান্ধব, আত্নীয়-স্বজন, এমনকি পাড়া প্রতিবেশীরাও তুহিনের মৃতদেহ এক নজর দেখার সুযোগ পায়নি। একজন মানুষের জন্য নিজের জন্মস্থানেই শেষ ঠিকানা পাওয়ার অধিকার যেমন স্বাভাবিক, তেমনই মানবিক। কিন্তু তুহিনের ক্ষেত্রে সেই অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়। এ ধরনের আচরণ শুধুমাত্র পাষবিকতারই প্রমাণ দেয় না, বরং এটি মানবতার প্রতিও চরম অবমাননা। তার নিজ এলাকায় দাফন না করে, তাকে তার নানার বাড়িতে সমাহিত করতে বাধ্য হওয়া—এ এক নির্মম এবং হৃদয়বিদারক ঘটনা যা মানবাধিকার ও ন্যায়ের চরম লঙ্ঘন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের বক্তব্য মো: তুহিন আহমেদ ছিল এক অনন্য মানুষ। সবসময় হাসিখুশি, সবার সঙ্গে মিশুক এবং তার চারপাশের সবাইকে আনন্দিত রাখার চেষ্টা করত। আমরা তাকে কখনো কারো সাথে ঝগড়া করতে দেখিনি। তার ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের জন্য এলাকাবাসীর কাছে সে ছিল অত্যন্ত প্রিয়। এত কম বয়সেই সে ছিল একজন সাহসী যুবক, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কখনো ভয় পেত না। তাই প্রতিদিনই সে আন্দোলনে যেত, যেন সে সমাজের অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। তবে আজ তাকে আর আমাদের মাঝে দেখতে পাই না। এতো সৎ, সাহসী এবং উদার একটা ছেলেকে কেন এভাবে প্রাণ দিতে হলো। সেটা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। মো: তুহিনের মৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি। এত তরুণ একজনের জীবনের এত নিষ্ঠুর সমাপ্তি আমাদেরকে বেদনাগ্রস্ত করে তোলে প্রস্তাবনা : বাবার ব্যবসা পুনরায় চালু করার জন্য আর্থিক সহযোগিতা করা যায়। : আনিুমানিক খরচ ১০ লাখ টাকা সন্তানের পড়াশোনার খরচ বহন করা। এক নজরে শহীদ মো: তুহিন আহমেদ নাম : মো: তুহিন আহমেদ জন্ম তারিখ ও বয়স : ২১ জানুয়ারী ১৯৯৩, ৩২ বছর স্থায়ী ঠিকানা : সোনারামপুর, বাঞ্চারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পেশা : টাইলস মিস্ত্রি পিতা : ছগির আহমেদ, বয়স-৪৫ ক্ষুদ্র ব্যবসাী মাতা : তাহমিনা বেগম ,বয়স-৩৯, গৃহিনী মাসিক আয় : ১০০০০/- আয়ের উৎস- ব্যবসা পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৩ জন আয়াতুল : বয়স-৪ বছর, সম্পর্ক-ছেলে শাহাদাত বরণের স্থান : যাত্রাবাড়ী আক্রমনকারী : সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে আহত হওয়ার তারিখ : ২০ জুলাই ২০২৪, শনিবার, আনুমানিক বিকাল ৫:৩০ টা শহীদ হওয়ার তারিখ : ২৩ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার, রাত ১১ টা দাফন করা হয় : নানুর বাড়ির গ্রামে, মানিকগঞ্জ ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : গ্রামে ভিটাজমিতে একটি টিনের বাড়ি আছে, অন্য কোন জায়গা জমি নাই