জন্ম তারিখ: ২১ অক্টোবর, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : অটোরিক্সা চালক, শাহাদাতের স্থান : মহিপাল, ফেনী
বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি ঘেরা জেলা লক্ষীপুর। শহিদ মোহাম্মদ সবুজ ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর রামগতি উপজেলার লক্ষীপুর জেলার। দক্ষিণ টুমচর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ সবুজের পিতার নাম। আবদুল মালেক। তাঁর পিতা পেশায় একজন রিকশাচালক। সাত ভাই-বোনের মাঝে সবুজ ছিলেন তৃতীয়। সাগরের হিম শীতল বাতাসে বেড়ে উঠা সবুজ কর্মের প্রয়োজনে চলে আসেন ফেনীতে, চালাতেন অটো রিক্সা। দারিদ্রের নিষ্পেষণ সবুজকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে দেয়নি। জীবিকার প্রয়োজনে তিনি রিক্সা চালানো শুরু করেন। ধরেন পরিবারের হাল। ঘটনা সংক্রান্ত বিবরণ ৪ আগস্ট ২০২৪। এদিন বাংলাদেশের জন্য একটি অন্ধকার অধ্যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতা নেমে আসে এক মহৎ লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু সেদিন নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর নেমে আসে আওয়ামী লীগের ঘাতক বাহিনীর নির্মম আক্রমণ, যে আক্রমণে জীবন হারান মো: সবুজসহ আরও ৯ জন। তারা ছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রামী, যারা ফ্যাসিবাদী দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল মাথা উঁচু করে। সবুজ ছিল ফেনীর এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। জীবিকার তাগিদে তিনি রিকশা চালাতেন। কিন্তু তার অন্তরে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক দুর্নিবার প্রতিবাদী সত্ত্বা। ৪ আগস্ট সকালে তিনি রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হন। নিজের জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্যেও দেশের স্বার্থের প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল অবিচল। সেদিন রিকশার মালিক তাকে ফোন করে রিকশা জমা দিতে বলেন। সবুজ রিকশা জমা দিয়ে মহিপালে চলে যান, যেখানে ছাত্ররা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। তখনও কেউ ভাবেনি, কিছুক্ষণ পরই মহিপালের সেই সড়ক রক্তে ভেসে যাবে। সেদিন ট্রাংক রোড থেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগের সশস্ত্র বাহিনী মহিপালে এসে হাজির হয়। তারা নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়, নির্বিচারে গুলি ছোঁড়ে, যেন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রতিবাদী কণ্ঠগুলো চিরতরে থামিয়ে দেওয়া। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা তখনও বুঝতে পারেনি যে তাদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলি ঘনিয়ে আসছে। সবুজ তার বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বন্দুকধারীদের এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ভিডিও ধারণ করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই অন্যায়ের প্রমাণ সংগ্রহ করা, জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই প্রমাণ সংগ্রহের আগেই তার জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা তাকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। সবুজকে প্রথমে গুলি করে আহত করা হয়, পরে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার মতো একজন সাহসী তরুণের জীবন অকালে ঝরে গেল, কিন্তু তার সংগ্রামের চেতনা আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। সবুজের মৃত্যু ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড এখানেই থেমে থাকেনি। আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী সার্কিট হাউজ রোডে যেখানে তাকে গুলি করে, সেই একই স্থানে আরও অনেক শিক্ষার্থীর ওপরও তারা হামলা চালায়। এই বর্বরতা যেন একটি পরিকল্পিত গণহত্যা ছিল, যা প্রতিবাদীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার জন্য চালানো হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা তখন নিজেদের বাঁচানোর জন্য ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাদের ক্ষুদ্র প্রতিরোধ ছিল আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে অসহায়। বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেই এলাকা পরিণত হয়েছিল এক যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা বারবার গুলি ছুঁড়ে জনতাকে আতঙ্কিত করে তুলছিল। সেদিনের এই আক্রমণে সবুজের মতো নিরীহ শিক্ষার্থীরা প্রাণ হারিয়েছে, শুধু তাদের জন্য নয়, বরং পুরো জাতির জন্য এই ঘটনা এক বড় শিক্ষা। আওয়ামী লীগের সশস্ত্র আক্রমণে সেদিন শুধু সবুজের জীবনই থেমে যায়নি, তার সঙ্গে আরও অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছিল। সবুজের হত্যাকাণ্ডের পরপরই তার মরদেহ ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের পুনরায় হামলার আশঙ্কা থাকায় তার ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি। নিরাপত্তার কারণে দ্রুত তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। সবুজ ছিল একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তিনি শুধু একজন রিকশাচালক ছিলেন না; তিনি ছিলেন ফেনীর সেই সংগ্রামী যুবকদের মধ্যে একজন, যারা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তার দরিদ্রতা কখনও তাকে নীতি থেকে বিচ্যুত করেনি। তিনি কখনও আপস করেননি, কখনও পিছু হটেননি। মো: সবুজের মতো একজন সাহসী তরুণের আত্মত্যাগ আজকের প্রজন্মের জন্য এক প্রেরণা। তিনি তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছেন, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার রক্তে ভেজা ফেনীর মাটি আজও সেই প্রতিবাদী সত্তার সাক্ষী। তার মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই কখনও থেমে থাকতে পারে না। সবুজের মৃত্যুর পর তার পরিবার শোকে নিমজ্জিত, তাদের জীবনে নেমে এসেছে এক গভীর অন্ধকার। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও সবুজের স্বপ্ন ছিল দেশের জন্য কিছু করা, কিন্তু আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সন্ত্রাসীরা সেই স্বপ্নকে নির্মমভাবে থামিয়ে দিয়েছে। সবুজের মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দমননীতি যতই কঠিন হোক, একদিন প্রতিরোধের শিখা জ্বলে উঠবেই। মো: সবুজ আজ আমাদের মধ্যে শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তার আত্মত্যাগ আমাদের মননে, চেতনায়, এবং প্রতিটি সংগ্রামে বেঁচে থাকবে। বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদমুক্তি আন্দোলনে তার অবদান চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। মামলা সংক্রান্ত তথ্য ফেনীর মহিপালে মো: সবুজ হত্যার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী-২ আসনের সদ্য সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ ৪৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৪ আগস্ট ২০২৪, ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে অটোরিকশাচালক মো. সবুজ নিহত হলে এ মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ৬৫ জনের নাম উল্লেখ করে মোট সাড়ে চারশ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি সবুজের বড় ভাই ইউসুফ বাদী হয়ে করেন। মামলার বিবরণীতে বলা হয়, ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সবুজ অংশ নেন। দুপুর ২টার দিকে ট্রাংক রোড থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুলি চালালে সবুজ সার্কিট হাউজ রোডের দিকে চলে যান। সেখানেই স্বপন মিয়াজী, জানে আলম, মাহবুবুল হক লিটন ও অর্নবের গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর অন্যান্য আসামিরা এগিয়ে এসে সবুজকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। সবুজের মরদেহ ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের পুনরায় হামলার আশঙ্কায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দ্রুত মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয়। দাফনের ৩৬ দিন পর আদালতের নির্দেশে ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরগাজী এলাকা থেকে মো: সবুজের মরদেহ উত্তোলন করা হয়। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য তার মরদেহ লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষ হলে পুনরায় তাকে দাফন করা হয়। এই ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলনের শিখা জ্বলে ওঠে। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য প্রতিবেশী শাহজাহান মানিক বলেন, সবুজ পরিবারের খুব অনুগত ছেলে ছিলো। তাঁর সম্পূর্ণ আয় বাবাকে বুঝিয়ে দিতো। তাঁর কোনো ধরনের খারাপ অভ্যাস ছিলো না। আরেক প্রতিবেশি পান্না আক্তার বলেন, সবুজ ভাই অত্যন্ত ভদ্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি বড়দের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। একজন অতুলনীয় মানুষ ছিলেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ অর্থনৈতিকভাবে খুবই অস্বচ্ছল। শহীদের পিতাও অটোরিকশা চালক। সাত ভাই-বোনের মধ্যে শহীদ ছিলেন ৩য় বাকী তিন ভাইয়ের মধ্যে ১ জন রিশসা চালক। ১ জন হোটেল বয় এবং ১ জন মানষিক প্রতিবন্ধী প্রস্তাবনা শহীদ সবুজের পরিবার বর্তমানে চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের আয় কম, অথচ প্রয়োজন অনেক। তাই নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো তাদের জীবনে স্থিতিশীলতা এবং সম্মানজনক জীবিকা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ১. বাসস্থানের জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন। ২. বাবার জন্য কর্মসংস্থান করা যেতে পারে। ৩. বড় ভাইকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ৪. প্রতিবন্ধী ভাইটির ব্যয়ভার গ্রহণ করা। এক নজরে শহীদ মো: সবুজ নাম : মোহাম্মদ সবুজ পেশা : অটোরিক্সা চালক জন্ম তারিখ : ২১ অক্টোবর ২০০৪ জন্মস্থান : দক্ষিণ টুমচর, রামগতি, লক্ষ্মীপুর নিজ জেলা : লক্ষ্মীপুর আহত হওয়ার তারিখ : ৪ আগস্ট ২০২৪ শহিদ হওয়ার তারিখ ও সময় : ৪ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ১:৪৫ শহিদ হওয়ার স্থান : মহিপাল, ফেনী মৃত্যুর স্থান : ঘটনাস্থলে (মহিপাল, ফেনী) দাফনের স্থান : দক্ষিণ টুমচর, রামগতি, লক্ষ্মীপুর কবরের জিপিএস লোকেশন : ২২ক্ক৩৬'০৯.৪"ঘ ৯১ক্ক০৩'১৮.২"ঊ পিতা : আবদুল মালেক (রিকশা চালক, বয়স ৪৫) মাতা : শাহনাজ বেগম (গৃহিণী, বয়স ৩৪) মাসিক আয় : ১০,০০০ টাকা আয়ের উৎস : রিকশা চালিয়ে পরিবার চালান পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৬ জন ভাই-বোনদের বিবরণ : ১. মোহাম্মদ ইউসুফ (বয়স: ২২, পেশা: রিকশাচালক) : ২. মোহাম্মদ ফয়সাল (বয়স: ১৮, পেশা: হোটেল কর্মচারি) : ৩. ইয়াসমিন আক্তার (বয়স: ২০, পেশা: ছাত্রী) : ৪. জাহিদ ইসলাম (বয়স: ৫, মানসিকভাবে অসুস্থ) : ৫. শাবনুর ইসলাম (বয়স: ১০, ছাত্রী, ৪র্থ শ্রেণি) ঘটনার স্থান : মহিপাল, ফেনী আক্রমণকারী : জিয়াউদ্দিন বাবলু (যুবলীগ সভাপতি, বালিগাও ইউনিয়ন) আহত হওয়ার সময় : ৪ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ১:৪৫ মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ৪ আগস্ট ২০২৪, মহিপাল, ফেনী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দক্ষিণ টুমচর, উপজেলা: রামগতি, জেলা: লক্ষ্মীপুর বর্তমান ঠিকানা : আদনান টাওয়ার, সার্কিট হাউজ (জামেয়া হাফসার পাশে), ফেনী সদর, জেলা: ফেনী
আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকা-প্রাপ্ত হয়ে থাকে। (সুরা আল-ইমরান ৩:১৬৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “শহীদদের জন্য জান্নাতে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।” (সহীহ বুখারী ২৮০০)
.jpg)
.jpg)
.jpg)
.jpg)