জন্ম তারিখ: ১৩ জানুয়ারি, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: ছাত্র ও গার্মেন্টস কর্মী, শাহাদাতের স্থান : আশুলিয়া থানার সামনে
মো: সুমন ইসলাম, জন্ম ১৩ জানুয়ারি ২০০৩, পঞ্চগড় জেলার, বোদা থানার ৯ নং সাকোয়া ইউনিয়নের আমিন নগর গ্রামে। তিনি ছিলেন একটি দরিদ্র পরিবারের একমাত্র ছেলে। সুমনের বাবা মো: হামিদ আলী, দিনমজুর, আর মা কাজলি, গৃহিণী। সুমন ছিল চার বোনের মধ্যে সবার ছোট। তাই আদরটাও পেতেন একটু বেশি। তিন বোনের চোখের মণি সে, আবার পড়াশোনাতেও অত্যন্ত মেধাবী। ব্যাবহার মিষ্টি হওয়ায় সহজেই সবার সাথে মিশে যান, নতুন কারও সাথে মিশতেও সময় লাগেনা। পড়াশোনায় মেধাবী সুমন জামিলাতুননেসা ফাজিল মাদ্রাসায় পড়ত এবং পড়াশোনার পাশাপাশি সে গার্মেন্টসে প্রডাকশন সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করে পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা করেন। পরিবারে জমি বলতে মাত্র চার শতক বসতবাড়ির জমি ছাড়া আবাদযোগ্য কোনো জমিই তাদের নেই। সুমন যা আয় করত তার বেশির ভাগ তাঁর বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবা মা'র ওষুধ কিনতেই ব্যয় করত সুমন। কেননা বাবা-মাকে যে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সুমন। ছোটবেলাতে যখন তাঁর বন্ধুরা মেলায় গিয়ে অনেক টাকা পয়সা খরচ করত তখন সে শুধু দেখত। মন চাইলেও যে কিছু নেয়া যাবেনা, কেননা বাবা- মা যে তাঁকে তাদের ওষুধের টাকা থেকে টাকা দিয়ে মেলায় আসতে দিয়েছে। সেটা দেখে সে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করে, বড় হয়ে ভালো কিছু হতে হবে। যে ভাবা সেই কাজ, কিন্তু দারিদ্রের করাল গ্রাস বার বার তাকে পড়ালেখা করতে বাধা দিয়ে যাচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে বাবা-মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে, বড় বোনদের শাসনকে কর্ণপাত না করে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। কিন্তু স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার করা বৈষম্যের কালো মেঘ যেন অন্যান্য সাধারণ মানুষের মত তাকেও ঘিরে ধরেছিল। তাই যখন বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিল সেও তাতে সম্পূর্ন একাত্মতা ঘোষণা করল। একাত্মতা না করে বা উপায়ই কি কোটা থাকলে যে সেও চাকরি পাবেনা, তার স্বপ্ন যে পূরণ হবেনা। তাই প্রতিদিন সে কাজের ফাঁকে যতটুকু সময় পেত ততটুকু সময়ই সমাবেশে যোগদান করার চেষ্টা করত। সেদিন ছিল ১৫ জুলাই, কিছুক্ষণ আগেই গার্মেন্টস ছুটি হয়েছে। সেদিন আর ওভার ডিউটি করারও ইচ্ছা নেই তার। তাই সে চলে গেল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে। যদি এখনও আন্দোলন চলে তাহলে সে সেখানে যোগদান করবে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। সেদিনই স্বৈরাচারী সরকারের ছাত্র নামক গুণ্ডা বাহিনী তাদের উপর অতর্কিত হামলা করে। উপায় না দেখে পাশের একটা চায়ের দোকানে আশ্রয় নেয়। সেদিন অনেক ভয় পেয়েছিল সে। কেননা কয়েকটা লাঠির আঘাত তারও লেগেছিল। আর নিজেরর চোখের সামনেই সরকারের পালিত গুণ্ডা বাহিনী একটা ফাটা বাঁশ দিয়ে একটা মেয়ের মাথায় আঘাত করল,সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি আল্লাগো বলে মাথা ধরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কাঁপা কাঁপা পায়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে সে রিকশায় উঠে বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়। রিকশার ঝাঁকিতে তার শরীরের সামনে তার চিন্তা গুলোও নাড়াচড়া করছিল। চোখের সামনে শুধু মেয়েটির সেই চিৎকারই ভেসে উঠছিল। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রিকশা তার বাসার সামনে নিয়ে এসেছে টেরই পায়নি। সেদিন রাতে কোনোমতে একটু খাবার আর ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলেও ঘুম আসেনি সারারাত। শুধু একটা কথাই ভাবতে থাকে, মানুষ এতটা নিষ্ঠুর নির্দয় হয় কি করে? আর সমবয়সী একজন সহপাঠী অন্যজনকে এত নির্মমভাবে মারতে পারেই বা কি করে? সে যতই এসব ভাবতে থাকে ততই স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি, ছাত্র নামক গুণ্ডাদের প্রতি, স্বৈরাচার পালিত অস্ত্রধারী পুলিশের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা জন্মাতে থাকে। এরপরদিন থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। মোবাইলে ছত্রলীগের গুণ্ডাবাহিনীদের অত্যাচার সে দেখতে থাকে আর মনে মনে ফুঁসে উঠতে থাকে। এরপর কয়েকদিন তার আর আন্দোলনে আসা হলোনা। আজকাল গার্মেন্টস মালিকরা তাদের বেশিই খাটিয়ে নিচ্ছে। এর কারণটা সে বুঝতে পারেনা। সে ভাবে দেশের যে পরিস্থিতি কয়েকদিন পরে হয়ত অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ বন্ধ করে দিতে হবে তাই। এতো এতো কাজের চাপে তার আর আসার সুযোগ হচ্ছেনা তার উপরে ১৯ জুলাই থেকে আবার সকল ধরনের ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই আন্দোলন যে কোনদিকে মোড় নিচ্ছে কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছেনা। পত্রিকাতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাও আবার ভাসা ভাসা তথ্য। কোনো ভাবেই সে আর ঘরে টিকতে পারেনা। এর মধ্যেই তার ধারণাও ঠিক হয় । গার্মেন্টস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। অবশেষে সে ৪ আগস্ট আশুলিয়াতে দেখতে পায় শত শত স্কুল- কলেজের ছাত্র আন্দোলন করছে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। যোগ দেয় তাদের সাথে। ছাত্রদের দেয়া প্রতিটি স্লোগানে যেন তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। সে ভাবে স্লোগান গুলোর মধ্যে এত জোর ! সেও তাদের তালে স্লোগান দিতে শুরু করে,' রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায় ',দিয়েছিত রক্ত আরও দিব রক্ত, তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার।' প্রতিটি স্লোগান যেন তার সাহস আকাশচুম্বী করে দিচ্ছিল। হঠাৎ সে পিঠে একটা তীব্র আঘাত অনুভব করে। সে আঘাতের চোটে চিৎকার দিয়ে ওঠে। বুঝতে পারেনা কি এমন লাগল তাকে, চোখ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। চোখ খুলে দেখে চারিপাশে সাদা ধোঁয়ায় অন্ধকার, নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে আর দাম দাম করে আকাশ ফাটানো শব্দ। সকলে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। সুমন অনুভব করে সে তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাঁকে এখন কি করা উচিৎ সে যেন ভেবেই পাচ্ছেনা। হঠাৎ কোথা থেকে দুইজন ছেলে এসে একজন হাত ধরে অন্যজন তার দুটি পা ধরে একটা আধা অন্ধকার গলির মধ্যে নিয়ে যায়। ছেলে দুটির বয়স সে আন্দাজ করার চেষ্টা করে ২০ বা ২২ হবে। তাকে শুয়ে রেখে ছেলে দুটি কোথায় যেন চলে যায়। আশেপাশেই হয়ত কিছু মানুষ গল্প করছিল সেখান থেকেই শুনতে পায়, আজ মিছিলে নাকি নিষ্ঠুর সরকারের পালিত পুলিশলীগ এলোপাথাড়ি রাবার বুলেট ছুঁড়েছে,এর সাথে আবার কাঁদানে গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডও নিক্ষেপ করেছে। সে বুঝতে পারে এসব আকাশ ফাটানো শব্দ তাহলে সাউন্ড গ্রেনেডেরই ছিল। অনেক্ষণ অপেক্ষা করে সে দূর থেকে একটা রিকশা ডাক দেয়, রিকশা কাছে আসলে সে কোনোমতে রিকশায় ওঠে কিন্তু উঠতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তার মনে পিঠের পেছনে হয়ত মাংশ পঁচে গিয়েছে। কোনোমতে সে বাসায় এসে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়েই ঘুমিয়ে পরে। পরদিন ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে দশটা বেজে গেছে। গতদিনের তুলনায় আজ একট সুস্থতা অনুভব করে সে। কোনোমতে হাল্কা খাওয়া দাওয়া করে সে আবার বিছানায় যায়। জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে আর ভাবছে আল্লাহ কি কোনোদিনই ডাকু শেখ হাসিনার পতন ঘটাবে না? এসব ভাবতে ভাবতেই সে রাস্তা থেকে একটা চিৎকার শুনে লাফ দিয়ে ওঠে বিছানা থেকে। সুমন শুনতে পায় কে যেন চিৎকার করে বলছে খুনি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে। আর দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। কথাটা শুনেই সে বিছানা থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে কাপড় বদল করতে থাকে। রাস্তার লোক যেন তাকে ডাকছে, রাস্তার মিছিল তাকে ডাকছে। সে তার গতকালের আহতের কথা ভুলেই গিয়েছিল। সে অনুভব করে তার শরীরে আর কোনো ব্যাথা নেই হয়ত আনন্দের উত্তেজনায়। বাইরে যেতে একটা লোক তার সাথে কোলাকুলি করে বলে ঈদ মোবারক, দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। কথাটি শুনে তার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা টপটপ করে পড়তে থাকে। সে দৌড় দেয় রাস্তার দিকে, দেখে সবাই আনন্দ করছে, হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে। অন্য একদল রাস্তায় বিশাল মিছিল বের করেছে। সে তাতে যোগদান করে। আনন্দে তার হাত পা কাঁপছে। যখনই তারা আশুলিয়া থানার সামনে আসে হঠাৎ কোথা থেকে যেন স্বৈরাচারী হাসিনার প্রেতাত্মা ঘাতক পুলিশ গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। একটা কি যেন তার বুকে লাগল সে বুঝতে পারল। বুকে হাত দিয়ে দেখে তার পুরো হাত লাল। আর তার শরীর বেয়ে গরম কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। সুমন চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে সে রাস্তায় লুটিয়ে পরে। সেখানেই তার প্রাণপাখি বের হয়ে যায়। বিজয় মিছিলের সম্পূর্র্ন স্বাদ আর নেয়া হয়না সুমনের। পরিবারের হালটাও আর তার ধরা হয়না। জানাজা ও দাফন হঠাৎ বাড়ির সামনে লাশবাহী গাড়ি দেখে আঁতকে ওঠে সুমনের মা কাজলী। দেখতে পায় ধীরে ধীরে কাফন পড়া কাউকে গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। কেন যেন লোকগুলো তা বাড়ির আঙিনায় শুইয়ে দেয় লাশটিকে। লাশের মুখের উপর থেকে ধীরে ধীরে কাপড় উঠালে সুমনের মা লাশের মুখটি দেখে একবার চিতকার দেন এরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আশেপাশের কিছু প্রতিবেশি মহিলা তাঁর মাথায় পানি ঢালতে থাকে। খবর পেয়ে বাইরে থেকে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে সুমনের বাবা। এরপর তিনিও স্তব্ধ হয়ে যান। তার বোনেরা জানতে পেরে তারাও কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে আদরের ছোট ভাইটিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য। ধীরে ধীরে সুমনকে বড়ই পাতা, গরম পানি দিয়ে গোসল করানো হয়। গোলাপজল ছিটিয়ে দেয়া হয় তার গায়ে। এরপর জানাজা করা হয় আমিন নগরেরই স্থানীয় মসজিদের পাশে এবং এখানেই তাকে কবরস্থ করা হয়। তার বাবা-মা এবং তিন বোন অসহায় হয়ে পড়ে। অধিক শোকে তার বাবা- মা পাথরের মত হয়ে যায়। কেননা তাদের আশার শেষ প্রদীপটিও যে নিভে গেল। একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: সুমন ইসলাম জন্ম তারিখ : ১৩ জানুয়ারি ২০০৩ বাবার নাম : মো: হামিদ আলী মায়ের নাম : কাজলি পেশা : ছাত্র ও গার্মেন্টস কর্মী বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: আমিন নগর, ইউনিয়ন: ৯ নং সাকোয়া, থানা: বোদা, জেলা পঞ্চগড় স্থায়ী ঠিকানা : ঐ পরিবারের সদস্য : ৩ জন এছাড়া ৩ বোন বিবাহিতা আঘাতকারী : পেটুয়া পুলিশ লীগ আহতের সময় ও স্থান : ৫ আগস্ট, ২০২৪ আনুমানিক বিকাল ৪ টায় আশুলিয়া থানার সামনে মৃত্যুর সময় ও স্থান : ঐ