জন্ম তারিখ: ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: রংমিস্ত্রী, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেলে
মো: বাবুল হাওলাদার ১৯৭২ সালের ০৩ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার গাওলিয়া ইউনিয়নের আপড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদের পিতার নাম জাবেদ আলী হাওলাদার ও জননী সুফিয়া বেগম। শহীদের পিতা পেশায় একজন দিনমজুর ছিলেন। আর মা পুরোদস্তুর গৃহিণী। যে কারণে পারিবারিক অবস্থা পূর্ব থেকেই শোচণীয় ছিল। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর শহীদের বোন সাংঘাতিক অসুস্থতায় পতিত হয়। একমাত্র বোনের চিকিৎসা খরচ যোগাতে বাধ্য হয়ে পৈতৃক জমি বিক্রি করে রাজধানী অভিমুখী হন শহীদ বাবুল হাওলাদার। যান্ত্রিক শহরের অভিজ্ঞতা ঢাকা মহানগরীর রামপুরার উলন নারিকেলবাগ আবাসিক এলাকায় প্রিয় পত্নীকে নিয়ে এক কামরা বিশিষ্ট একটি ভাড়া বাড়িতে দিনাতিপাত শুরু করেন দেশপ্রেমিক হাওলাদার। গাঁয়ের দিনগুলোতে থাকতে আবির শৈলীর কাজ শিখেছিলেন। নতুন শহরে এসে সেই রং মিস্ত্রির কাজকেই তিনি নিজের পেশা হিসেবে বহাল রাখলেন। শুরু করলেন যান্ত্রিক শহরের প্রচলিত পরিশ্রম। কিছুদিন পর শহীদ স্ত্রী মানোয়ারা বেগমের কোল জুড়ে ধরাধামে আসেন প্রথম পুত্র পারভেজ। একমাত্র ছেলের আগমনে সংসারের চিত্র বদলাতে থাকে। পরিবারে উৎসব আমেজ বিরাজ করতে শুরু করে। একে একে জন্ম নেয় হাসান ও পারভিন। পরিবারে যেন চাঁদের হাট বসে। ধীরেধীরে শহীদের সন্তানেরা বড় হয়। দুই ছেলেকে ড্রাইভার হিসেবে গড়ে তোলেন জনাব বাবুল হাওলাদার। কিছুদিন পর কন্যাকে পাত্রস্থ করেন। দুই ছেলে উপার্জন শুরু করলে পরিবারের অর্থ মন্দা কাটতে শুরু করে। বর্তমানে তার দুই পুত্র ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার চালক। তাদের রোজগারে শহীদ বাবুল হাওলাদারের রেখে যাওয়া সংসার এখনও যেন প্রানবন্ত। হঠাৎ দেশে তীব্র আন্দোলনের ডাক আসে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। যার আদি শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। ‘যতবার দেশে অধিকার আদায়ের দাবি উত্থাপিত হয়েছে, ততবারই খুনি হাসিনা ও তার দলবল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।’ ১৯৪৭-২০২৪ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ পরিক্রমা ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ধর্মের ভিত্তিতে দুইটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হয়-ভারত এবং পাকিস্তান। ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ কলঙ্কিত অধ্যায়। বিতর্কিত সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৪ মার্চ, ১৯৪৮ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।' জিন্নাহর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে উপস্থিত ছাত্রদের একটি অংশ তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ জানায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিলো। সমবেত ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ করে; ঘটনাস্থলে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ এবং আব্দুল জব্বার-তিনজন মারা যান। হাসপাতালে মারা যান আব্দুস সালাম। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ হাজারো মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ১৯৫৬ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি কার্যকর হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন ভাষা শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। ১৯৬৯ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২ মার্চ ১৯৭১ কারফিউ ভেঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। ৭ মার্চ ১৯৭১ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবকে দুই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে ঘোষিত হয় “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম,স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে বিহারী-পাঞ্জাবীদের হত্যা, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া সম্পদ লুট, ক্যান্টমেন্টে গুলোতে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পরিচালিত হয় অপারেশন সার্চলাইট। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। চারিদিকে বিজয় উৎসব। ১৯৭৫ জানুয়ারি, বাকশাল গঠন। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের প্রস্থান ঘটে। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৮২ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালে নির্বাচনের আয়োজন করে আবারো রাষ্ট্রপতি হন তিনি এবং শেষে প্রবল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। ১৯৯৬ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৮ আবারো ক্ষমতায় আসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী খুনি শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের ০৫ মে শাপলা চত্তরে হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করে স্বৈরাচারী হাসিনার দোসর আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনী। ক্ষমতায় এসে দেশকে লুটের রাজ্য এবং হত্যাযজ্ঞে পরিণত করে হাসিনা ও তার দলবল। ২০১৪ সালে ব্যালট বক্স লুট করে তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসে ফ্যাসিবাদী সরকার। নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। ২০১৮ আবারও ভোট চুরি করে চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন রক্তখেকো হাসিনা। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ইন্ধনে ২৯ জুলাই রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজিব ও দিয়াকে বাস চাপা দিয়ে পিষ্ট করে হত্যা করা হয়। ২৯ জুলাই থেকে ০৮ আগস্ট এর প্রেক্ষিতে তীব্র নিন্দা জানিয়ে ছাত্র-জনতা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে। আন্দোলন প্রতিহত করতে বিতর্কিত সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামী ছাত্র লীগের ক্যাডাররা শিক্ষার্থীদের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। চারিদিকে ব্যাপক সহিংসতা চালায় খুনী হাসিনার দোসরারা। যতবার দেশে অধিকার আদায়ের দাবি উত্থাপিত হয়েছে, ততবারই খুনি হাসিনা ও তার দলবল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ২০২৪ পঞ্চম বারের মত ভোট ডাকাতি করে আরও ভয়ঙ্কর রূপে ক্ষমতায় আসে নরখাদক শেখ হাসিনা। তবে এবার আর পেশী শক্তি দিয়ে টিকে থাকতে পারে না স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। দেশ থেকে পলায়ন করে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হয়। ‘আন্দোলন ও বিক্ষোভ-সংঘর্ষে বেশি মৃত্যু হয়েছে শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষের’ স্বৈরাচারের উচ্ছেদিত ঘটনা জুলাই-আগস্ট ২০২৪। চারিদিকে তখন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলে। ছাত্ররা অলিগলি মহাসড়ক অবরোধ করে তাদের দাবি দাওয়া উত্থাপিত করে। আন্দোলনকে প্রতিহত করতে তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি ইন্ধন দেন। দলীয় ছাত্রদের হাতে লাঠিসোঁটা, রামদা, চাপাতি, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, ককটেল, দেশীয় অস্ত্র, রাইফেল প্রভৃতি তুলে নিতে বলেন। সরাসরি পুলিশ বাহিনীকে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, ছড়রা গুলি, ও ফায়ারের নির্দেশ দেয়া হয়। যার নেতৃত্বে ছিল ঘাতক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডিবি প্রাধান হারুন ও তার বাহিনী। এসব বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে যায় ছাত্ররা। আন্দোলন ও বিক্ষোভ-সংঘর্ষে বেশি মৃত্যু হয় শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষের। যেভাবে তিনি শহীদ হন স্বৈরাচার খুনি হাসিনার বরাদ্দকৃত কোটার বিরুদ্ধে সারাদেশের জনগণ আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ শামিল হয়। শহীদ বাবুল হাওলাদার তার বড় ছেলেকে নিয়ে ১৯ জুলাই ২০২৪ বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। মিছিলটি পলাশবাগে শুরু হয়ে রামপুরার দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ পুলিশ গুলি ছোড়ে। পারভেজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সেদিন সন্তান পালিয়ে যেতে পারলেও পিতা হাওলাদার পালিয়ে যেতে পারেনি। পুলিশের একটি গুলি তার শরীরে এসে আঘাত হানে। জখম হয়ে কাৎরাতে থাকেন তিনি। অতঃপর তাকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। দীর্ঘ আটদিন আইসিইউ থাকার পর ২৮ জুলাই শাহাদত বরণ করেন তেজস্বী বীর শহীদ বাবুল হাওলাদার। পরবর্তীতে এই মহান গুনির লাশ জানাজা শেষে আজমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঘটনার প্রমান নিহতের শ্যালক সাজু বেপারী বলেন, আমার দুলাভাই শহীদ বাবুল হাওলাদার গত ১৯ জুলাই ২০২৪ তারিখে বাম হাত ও গলার নিচে গুলি বিদ্ধ হয়। সেই অবস্থায় আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। নয়দিন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২৮ জুলাই রাত ৮.২০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে থাকি।’ (সুরা তাওবা : ১১১)। এক নজরে শহীদ মো: বাবুল হাওলাদার নাম : মো: বাবুল হাওলাদার, পেশা: রংমিস্ত্রী জন্ম তারিখ ও বয়স : ০৩-০২-১৯৭২, ৫৬ বছর শহীদ হওয়ার তারিখ : ২৮-০৭-২০২৪, রাত ৮:২০ মিনিট শাহাদাত বরণের স্থান : ঢামেক দাফন করা হয় : আজিমপুর কবরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: আপড়, আশালির চর উপজেলা: লৌহজং, জেলা: মুন্সিগঞ্জ পিতা : জাবের আলী হাওলাদার (মৃত) মাতা : সুফিয়া বেগম (মৃত) স্ত্রী : মানোয়ারা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : পৈতৃক বাড়ি বা আবাদি জমি নেই সন্তানের বিবরণ : দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেদ্বয় ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার চালক, মেয়ে বিবাহিতা প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারের বাসস্থান প্রয়োজন। স্থায়ী বাসস্থান বা জমি নেই ২. শহীদের চিকিৎসা খরচ যোগাতে পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঋণ পরিশোধে সহায়তা করা যেতে পারে। ঋণের পরিমাণ-৫০,০০০/- টাকা ৩. শহীদের স্ত্রীকে মাসিক সহযোগিতা করা যেতে পারে