জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ০০০১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: সিলেট
পেশা : চাকুরীজীবী, শাহাদাতের স্থান : সংসদ ভবন এলাকা
সোহাগ মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামে। জেলা শহর থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। তার বাবার নাম আবুল কালাম এবং মায়ের নাম রোকেয়া বেগম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ৫ আগস্ট ঢাকার বাড্ডায় গুলিতে নিহত হন সোহাগ মিয়া (২৩)। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সোহাগ ছিলেন দ্বিতীয়। ঘটনার প্রেক্ষাপট খুনি শেখ হাসিনা সরকারের দূর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, শিক্ষা ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা ধ্বংসসহ সকল ক্ষেত্রে অদক্ষ, দলীয় ও লম্পট লোকেদের প্রাধান্যের ফলে দেশবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। ভারতের সাথে দেশের স্বার্থ বিরোধী গোপন চুক্তিতে দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। হাসিনা সরকার ২০০৮ সালে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে ক্ষমতায় আসার পরে দেশপ্রেমিক নাগরিক ও প্রতিবাদী জনতাকে আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে আটক, গুম, খুন করতে থাকে। বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি মাঝে মাঝে আন্দোলনের ডাক দিলেও রাজপথে শক্ত অবস্থান নিতে ও নব্য ফেরাউন সরকারকে হঠাতে চরমভাবে ব্যার্থ হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের অনেক নেতা-কর্মী টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। একারণে তাদের আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া রাজপথে আন্দোলনের ডাক দিলেও এদলের নেতা-কর্মীরা নেত্রীর আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে। ফলে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। তার দুই পুত্রকে পেটানো হয়। ছোট ছেলে কোকো রহমান এক পর্যায়ে হাসিনা সরকারের অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করেন। বড় ছেলে তারেক জিয়া নির্বাসনে লন্ডনে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। স্বৈরাচারের ১৫ বছরের শাসনে বিএনপি মুসলিম লীগের মতো সংখ্যালঘু দলে পরিণত হয়। শেখ হাসিনা বিএনপির নেতা-কর্মীদের কিনে নিতে পারলেও দেশের বড় ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কিনতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষমতায় থাকতে জামায়াত নেতাদের আটক, গুম ও খুন করা শুরু হয়। কেউ ন্যায়ের পক্ষে কথা বললে, সরকারী দলের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কিংবা যেকোন আন্দোলন হলে হাসিনা ও তার এমপি মন্ত্রীরা প্রতিবাদকারীদের জামায়াত-শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালাতো। মিডিয়া গুলো জামায়াত-শিবির নির্যাতনে সরকারকে উৎসাহিত করতো। অবস্থা এমন দাড়ালো যে কাউকে জামায়াত-শিবির অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা করা বৈধ একটি কাজ। হাসিনা সরকার চিরস্থায়ী ভাবে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা নেয়। তারা সরকারী চাকুরীতে অযৌক্তিক মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে ২০১৮ সালে প্রতিবাদের মুখে বাতিল করলেও ২০২৪ সালে আবার হাইকোর্টে দলীয় বিচারকের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনে। তাদের উদ্দেশ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটার মাধ্যমে দলীয় অদক্ষ লোকেদের চাকুরীতে নিয়োগ দিয়ে হাসিনা শাসন চিরস্থায়ী করা। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা কোটা প্রথা নিষিদ্ধ করতে শুরু করে দেয় প্রতিবাদ। টোকাই ও ধর্ষক লীগ নামে খ্যাত ছাত্রলীগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে লাঠিপেটা করে। জুলাই মাস জুড়ে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, আনসার ছাত্র-জনতাকে দমনে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। আহত ও নিহত হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়ে কারফিউ দেয়া হয়। ছাত্র-জনতাকে বাসা থেকে গ্রেফতার করা হতে থাকে। দেশবাসী প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ছাত্রদের এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রীয়তার সাথে পাশে এসে যুক্ত হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। তারা দফায় দফায় কর্মসূচী দিয়ে আন্দোলনকে পরিপূর্ণতা দান করে। তারা ৯ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করে। ১ আগস্ট শেখ হাসিনা জামায়াত ও শিবিরকে সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দেশের মানুষ এ ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বুঝতে পারে হাসিনা অতীতের মতো আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির আখ্যা দিয়ে গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজপথ আরো বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ৪ আগস্ট ১ দফা সরকার পতনের ঘোষণার ফলে ৫ আগস্ট দেশের মানুষ রাজপথে নেমে পড়ে। শেখ হাসিনা তার পতন ঘন্টা বেজে উঠতে দেখে ভারতে পালিয়ে যায়। দুপুর বেলায় জনতা এমন সংবাদে সংসদ ভবন, শেখ হাসিনার বাড়ি প্রভৃতি স্থানে আনন্দে ছুটে আসে। সোহাগ মিয়া তার ভাই শুভ মিয়াকে নিয়ে সংসদ এলাকায় ছুটে যান। হাসিনা পালিয়ে গেলেও পুলিশ-বিজিবির প্রতি তার নির্দেশ ছিল গণহত্যা পরিচালনা করার। সোহাগ মিয়া এসময় গুলিবিদ্ধ হন। ছোটভাই শুভ মিয়া ভাইকে বাঁচাতে গেলে তিনিও গুলিতে আহত হন। গুলিবিদ্ধ সোহাগ ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করেন। সোহাগের মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। মঙ্গলবার ভোরে সোহাগের মৃতদেহ জামালগঞ্জে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলে সর্বস্তরের জনগণ দেখতে ছুটে যান। পরে দুপুর ২টায় জামালগঞ্জ হেলিপ্যাড মাঠে সব শ্রেণিপেশার মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিবারের বক্তব্য ও অর্থনৈতিক অবস্থা ‘লাশ দেইখ্যা তো আমি বেহুঁশ। অত গুলি কি লা করল। ছেলেটার বুক গুলিতে ঝাঁঝরা আছিল। আমার ছেলের বুকখান চোখও লাগি রইছে। আমরা অখন কিলা চলমু, আমারে ওষুধের টেখা দিব কেটায়।’ কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন ষাটোর্ধ্ব আবুল কালাম (৬৪)। ছেলের কথা মনে হলেই তিনি নীরবে কাঁদেন। হতদরিদ্র আবুল কালাম ছেলেকে হারিয়ে এখন দিশাহারা। তাঁর আফসোস, ছেলেটা দেনার চাপে ছোট ভাইকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন। বলেছিলেন, ঋণ শোধ করে গ্রামে ফিরবেন। কিন্তু এভাবে লাশ হয়ে ফিরবেন, কখনো ভাবতে পারেননি আবুল কালাম। আবুল কালাম এক সময় এলাকায় রিকশা চালাতেন। এখন বয়স হওয়ায় ও রোগে-শোকে কাজ করতে পারেন না। বাড়িতেই থাকেন। আবুল কালাম জানান, তাঁর পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে বড়, বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের মধ্যে সোহাগ দ্বিতীয়। চার বছর আগে সোহাগ সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেন। এরপর জমি, ঘরের গরু আর মহাজনি সুদে ঋণ নিয়ে প্রায় চার লাখ টাকা জোগাড় করে দালালকে দেন। কিন্তু সব টাকা খোয়া যায়। এরপর সুদের টাকার চাপে ছোট ভাই শুভ মিয়াকে (২০) নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালান সোহাগ মিয়া। ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারখানায় কাজ নেন দুই ভাই। থাকতেন বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায়। যা আয় করতেন মাসে মাসে সেখান থেকে কিছু টাকা পাঠাতেন বাড়িতে। সেই টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করছিলেন বাবা। হৃদ্রোগে আক্রান্ত আবুল কালামের চিকিৎসার খরচও দিতেন সোহাগ। আবুল কালাম বলেন, ‘একটা ভাঙা ঘরে থাকি। বেড়া নাই, টিন নাই। মেঘ আইলে (বৃষ্টি হলে) পানি পড়ে। একবেলা খাইলে, দুইবেলা উপাস যায়। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, সোহাগের পরিবার খুবই দরিদ্র। যে গাড়ি লাশ নিয়ে এসেছিল, সেটার ভাড়ার টাকাও গ্রামের লোকজন দিয়েছেন। গ্রামের বাসিন্দা আইনজীবী মো: শাহিনুর রহমান বলেন, সোহাগ মিয়া মারা যাওয়ায় দরিদ্র পরিবারটি আরও অসহায় হয়ে পড়ল। এখন আহত শুভ মিয়ার চিকিৎসা ও পরিবারটি কীভাবে চলবে, সেটাই চিন্তার বিষয়। তাদের পাশে সরকারের দাঁড়ানো উচিত। নিহতের বড় ভাই বিল্লাল মিয়া জানান, নিহত সোহাগ মিয়া ও তার ছোট ভাই শুভ মিয়া ঢাকায় বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। গত ৫ জুলাই দুপরে ঢাকায় সংসদ ভবনের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের সময় সোহাগ গুলিবিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ সময় সঙ্গে থাকা ছোট ভাই শুভ মিয়া তার গুলিবিদ্ধ ভাইকে বাঁচাতে গেলে সে নিজেও আহত হয়। বর্তমানে সে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে। প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারের জন্য নিয়মিত মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়া ২. স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া। একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : সোহাগ মিয়া পেশা : চাকুরীজীবী বাবা : আবুল কালাম মা : রোকেয়া বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: গোলামীপুর থানা: জামালগঞ্জ জেলা: সুনামগঞ্জ ভাই : বিল্লাল মিয়া, সোহাগ মিয়া, শুভ মিয়া ঘটনার স্থান : সংসদ ভবন এলাকা আক্রমণকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময় : ৫ আগস্ট ২০২৪, আনুমানিক দুপুর ৩ টা আঘাতের ধরন : গুলিবিদ্ধ মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ৫ আগস্ট ২০২৪, সংসদ ভবন এলাকা শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : গোলামীপুর, সুনামগঞ্জ