জন্ম তারিখ: ১৫ অক্টোবর, ১৯৮১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: কাঠমিস্ত্রী, শাহাদাতের স্থান : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে
নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসেন আজ থেকে ৩৫ বছর আগে। গ্রামে ছিল তার কষ্টের জীবন। অভাব অনটনে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছিল। এরপর তার চলে আসেন রাজধানীতে। জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার দৃঢ়তা নিয়ে কাজ করছিলেন। রমজান আলী একজন সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। ছিলেন মাতৃভক্ত। ঘরে তার মা অসুস্থ। অসুস্থ মাকে সুস্থ করে তোলা তার জীবনের বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। যাবতীয় চিকিৎসা চালিয়ে যান। সংসারে একমাত্র রোজগারি মানুষ তিনিই। কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে তার আছে কেবল বসত ভিটা। বসবাস করার জমিটুকু ছাড়া আর কোন জমিজমা নাই। এক ছেলে, এক মেয়ে, মা ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। রমজান আলীর পিতা মৃত জনাব নুর হোসেন, মা খোদেজা বেগম। পরাশক্তির আগ্রাসন ৫ আগস্ট দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হয় দ্বিতীয়বারের মতো। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম অবিভক্ত পাকিস্তানের হয়ে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালে। তৎকালীন ভারতও আমদের সাথে চক্রান্ত করে। সহযোগিতার আবরণে বাংলাকে উৎখাত করতে পাকিস্থান ও ভারত রেজিম বনে যায়। এরপর ভারত পাকিস্থানের একত্রে আধিপত্যর বিরুদ্ধ্যে লড়তে গিয়ে আমরা বাঙ্গালীরা দীর্ঘ যুদ্ধ, কারাবাস, গুম, খুন, নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হঠকারিতা পার করে এক সবুজ শ্যামল সুজলা সুফলা নয়নাভিরাম ভূখণ্ড পেলাম। সীমান্ত পেলাম, পৃথক মানচিত্র পেলাম। আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদ মুক্ত হলাম। এই মুক্তি আবারও ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী শাসনামল। ২০০৯ সালে জনগণকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ক্ষমতায় আসে নরপিশাচ হাসিনা। আসার পর থেকে আবারও ফ্যাসিজম, গুম, খুন, রাহাজানি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করে খুনি হাসিনা সরকার ও তার পেটুয়া বাহিনী। একপর্যায়ে একেএকে কেটে যায় ১৫ বছর। আপামর জনতা ফুঁসে ওঠে। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকে রাজপথে নেমে আসে শিশু, থেকে শুরু করে কিশোর, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ সহ নানাবিঁধ মানুষ। আস্ফালনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় মুক্তিকামী জনতা। ঘাতক হাসিনার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধচারণ করতে গিয়ে শহীদ হয় অগণিত স্বাধীন বাংলার পরাধীন মানুষ। লাশের স্তূপ ও রক্তের বন্যায় ভেসে যায় আওয়ামী সন্ত্রাসবাদ। তাই ৫ আগস্টের মুক্তিলাভ মূলত দ্বিতীয় স্বাধীনতাই। যা সফল করতে হাজার মানুষকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। নির্যাতন, নিপীড়ন সইতে হয়েছে। বরণ করতে হয়েছে শাহাদাতের অমিয় মৃত্যু। দেশ মাতৃকার সে সমস্ত শাহাদত বরণকারী জুলাই বিপ্লবের শহীদদের প্রতি হাজারও শ্রদ্ধা নিবেদন রইলো। রেজিমের বিদায় ৫ আগস্ট এসেছে রক্তাক্ত জুলাইয়ের হাত ধরে। জুলাইয়ে শুরু হয় “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। পরবর্তীতে তা পরিণত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। এই আন্দোলন দমন করতে সরকার তার সকল অস্ত্র প্রয়োগ করে। সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করে দেশকে। একটি স্বাধীন দেশকে সরকার পরিকল্পিতভাবে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। একটি দেশে যুদ্ধ লাগলে যেসব পদক্ষেপ নেয় সরকার নিরীহ আন্দোলনকারীদের প্রতি তা প্রয়োগ করে। বিভিন্ন সূত্রমতে পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাবাহিনীর স্পেশাল ইউনিটও কাজ করে এই দমন কার্যক্রমে। সরকার পুলিশ, বিজিবিকে মাঠে নামায়। সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামায়। সমস্ত রকমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ম্যাসাকার করে। আন্দোলন তবু দমে যায়নি। আরও উত্তপ্ত হয়। সরকার তার নিয়মিত বাহিনীর সাথে যোগ করে দলীয় ক্যাডার বাহিনী। নির্যাতনে অংশ নেয় যুবলীগ, আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী কর্মীবাহিনী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এক কর্মসূচি আসতে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিচিত ছিল হরতাল,অবরোধের মতো কর্মসূচি। বৈষম্যবিরোধী কর্মসূচির নায়করা আন্দোলনে প্রয়োগ করে শাটডাউনের মতো শব্দ। জনমানুষ আকৃষ্ট হয়। প্রথমত শাটডাউন চলে শাহবাগ কেন্দ্রিক। তারপর ক্রমান্বয়ে আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে। শাটডাউন, কমপ্লিট শাটডাউনে চলে আসে সারাদেশ। পুলিশের গুলিতে, যুবলীগের গুলিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়তে থাকে লাশ। দেশ একসময় লাশের রাজ্য হয়ে পড়ে। একদিনে শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। শত্রু দমনের মতো সরকার ঠিক যুদ্ধবাজ ভূমিকায় নামে। টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেটের জায়গায় ব্যবহৃত হতে থাকে মারণাস্ত্র। সরাসরি গুলিতে প্রাণ চলে যায় শত শত জনতার। ছাত্র-জনতার সামনে পিছে হঠার সমস্ত রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বিজয় ও মরণ এই দুই সমীকরণের মাঝামাঝি আর কোনো অপশন অবশিষ্ট থাকেনি। সরকার হেলিকপ্টার থেকে গুলি নিক্ষেপ করে। অবশেষে আসে ৫ আগস্ট। লং মার্চ টু ঢাকা। গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি। জনজোয়ার নামে ঢাকায়। সফল হয় আন্দোলন। পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। আটশ বছরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। লক্ষণ সেনের পর শেখ হাসিনার পলায়ন। জাতি মুক্তি পায় ফ্যাসিস্ট, রেজিম, স্বৈরাচারের হাত থেকে। প্রাণ যায় শত মানুষের। শত নিরপরাধ মানুষের তরতাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বিজয়। তখনও স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা কোথাও কোথাও থেকে যায় হায়েনা রূপে। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পয়েন্টটিতে ওৎপেতে থাকে তখনও স্বৈরাচারের সন্ত্রাসী যুবলীগ ও পুলিশের খুনী বাহিনী। শাহাদতের প্রেক্ষাপট রমজান আলী একজন খেটে খাওয়া মানুষ। প্রতিদিনের মতো কাজ করে ফিরছেন বাসায়। পুলিশের একটি গ্রুপ মারণাস্ত্র নিয়ে যেন অপেক্ষায় ছিল কারও প্রাণ কেড়ে নেওয়ার নেশায়। ৫ আগস্ট মানুষেরা বিজয় মিছিল শেষে ফিরছেন বাসায়। রমজান আলী ফিরছেন কাজ শেষে। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসতেই পুলিশ গুলি ছোড়ে। আক্রান্ত হন রমজান আলী। ডান হাতের বাহুতে গুলি লাগে। সাথে সাথে লুটিয়ে পড়েন। রাত তখন দুইটা। পথচারীরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় ঐদিনই। রমজান আলীর মৃত্যুতে পরিবারটি চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ঢাকার মিনার মসজিদে তার প্রথম জানাজা হয়। দ্বিতীয় জানাজা হয় নিজ গ্রামে। নেত্রকোনায় স্থানীয় গোরস্থানে তাকে কবর দেওয়া হয়। প্রতিবেশীর বক্তব্য প্রতিবেশী আব্দুল কাদের বলেন,রমজান আলী একজন ভালো মানুষ ছিলেন। খুব বিনয়ী ও সৎ ছিলেন। সবার সাথে মিলেমিশে থাকতেন। কর্মঠ মানুষ ছিলেন। পরিবারের প্রতি ছিলেন দায়িত্ববান। মাতৃভক্ত সন্তান ছিলেন তিনি। রমজান আলীর মৃত্যুতে শোকাহত। দোষীদের বিচার চাই। প্রস্তাবনা তার মা অসুস্থ। পরিবারে উপার্জনের আর কেউ নাই। এককালীন অনুদানের প্রস্তাব করছি। মাসিক ভাতা দেয়া যায়। বাসস্থানের ব্যবস্থা জরুরি। ছেলের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগান প্রয়োজন। উপযুক্ত শিক্ষিত করতে সমস্ত খরচ ফ্রি করা দরকার। বিবাহ যোগ্য হলে বিবাহের খরচ বহন করা প্রয়োজন। প্রোফাইল নাম : মো: রমজান আলী জন্ম তারিখ : ১৫-১০-১৯৮১ সাল পিতা : মৃত জনাব নুর হোসেন মাতা : মোসা: খোদেজা বেগম পরিবারের সদস্য : মা, স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে পেশা : কাঠমিস্ত্রী শিক্ষাগত যোগ্যতা : ৫ম শ্রেণি স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দুন্ধি, ইউনিয়ন: বিলজোড়া, থানা: পূর্বদোলা, জেলা: নেত্রকোনা বর্তমান ঠিকানা : বাসা: ৯৫০, পোস্ট অফিস এলাকা, গুলশান ১২১২, থানা: গুলশান ঢাকা আহত : পুলিশের গুলিতে আহত ৫ আগস্ট রাত ২টায় (ডান হাতের উপরের অংশ) ঘটনার স্থান : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মৃত্যু : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কবর : নিজ গ্রাম মৃত্যু : ৫ আগস্ট, রাত ২টা, ২০২৪ সাল