Image of মো: নাজমুল কাজী

নাম: মো: নাজমুল কাজী

জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ১৯৯৫

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: চট্টগ্রাম

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান : শনির আখাড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ী

শহীদের জীবনী

’’পানি দিতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন যে যোদ্ধা’’ নাজমুল কাজী এই নাম এখন আর শুধু একটি পরিবারকে ডাকে না, এটি একটি আন্দোলনের ছায়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যেক নির্যাতিত হৃদয়ে। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই যেন বাতাস ভারী হয়ে আসে, ঘর ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে, আর স্তব্ধতার মাঝে কারা যেন বলে ওঠে “সে তো মিছিল করত না, সে তো কিছুই করত না, শুধু এক ফোঁটা জল দিয়েছিল।” হ্যাঁ, ঠিক তাই নাজমুল কাজী কোনো রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন না ব্যানার ধরে দাঁড়ানো কণ্ঠস্বর। তিনি ছিলেন সেই সাদাসিধে ব্যবসায়ী, যিনি ভাবতেন, সংসারই পৃথিবীর কেন্দ্র, আর সত্য আর সহানুভূতি তাঁর ধর্ম। তাঁর ছোট্ট পরিবার, স্ত্রী মারিয়া সুলতানা, আর কোলের শিশু আরিয়ানা কাজী নুজাইরাহ ছিল তাঁর জীবনের সমস্ত সৌরজগত। তিনি ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নিঃশব্দ স্বপ্নবান মানুষ। তাঁর পিতা, সেলিম কাজী, জীবনের পরিশ্রমী কৃষিজীবী, মা নাজমা বেগম একজন গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে একজন দুবাইতে, আরেকজন সৌদি আরবে। আর্থিক দিক থেকে, পরিবারটি ভালোই ছিল শান্ত, নিরাপদ, আলহামদুলিল্লাহ বলা যায়। কিন্তু ২০২৩-এর জুলাই আসছিল আগুন নিয়ে। রাজপথে ছাত্রদের বুক ফেটে কান্না বের হচ্ছিল, মায়েদের মুখে প্রার্থনার বদলে ক্রোধ জমছিল। নাজমুল দেখেছিলেন এই ভালো থাকা অনেকের কাছে এখন এক কল্পনার নাম। তিনি ছিলেন সাধারণ, কিন্তু ‘সাধারণ’ বলে যাঁরা সত্যকে পাশ কাটান, তিনি তাঁদের একজন ছিলেন না। সেই দিন, সেই বিপ্লবের বিকেলে, যখন চারপাশে গুলির শব্দ আর পুলিশি বুটের ধাক্কা, এক তরুণ তাঁর দোকানের পাশে এসে কাতর স্বরে বলেছিল “ভাইয়া, এক ফোঁটা পানি দেন।” সেই এক ফোঁটা পানি, সেই এক মুহূর্তেই নাজমুল নিজেকে ভিন্ন এক জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। পানির বোতল এগিয়ে দেওয়া সত্যি, কতটুকু সাহস লাগে? কিন্তু সেই মুহূর্তে, সেই রাজ্যে, সেটিই ছিল বিদ্রোহ। সেই পানি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তাঁর বুকে ধরা পড়ে এক স্নাইপারের নিখুঁত নিশানা। কোল থেকে শিশুটি হারাল বাবাকে, স্ত্রী হারাল জীবনের ছায়া। আর আমরা পেলাম এক নীরব বিপ্লবী, যিনি কোনো স্লোগান না দিয়ে, নিজের মৃত্যু দিয়ে বলে গেলেন “মানবতা কখনো নিরপেক্ষ নয়।” নাজমুল কাজীর মৃত্যু ছিল না কোনো দুর্ঘটনা, ছিল এক রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার ফল। তাঁর দোষ ছিল? শুধু একজন তৃষ্ণার্তকে পানি দেওয়া। এই এক ফোঁটা পানির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল রাজপথের সবচেয়ে দুর্বোধ্য সাহস। সেই পানি আরেকটি প্রাণ হয়তো বাঁচায়নি, কিন্তু এক জাতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই শাসনব্যবস্থা কতোটা ভীত, কতোটা কুৎসিত, কতোটা অমানবিক। আজ তাঁর নাম বলা মানে, চোখের কোনায় এক কণা জল আনা নয় বরং বুকের ভেতরে আগুন জ্বালানো। নাজমুল ছিলেন না নেতা, ছিলেন না বক্তা কিন্তু আজ, শহীদদের কাতারে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চারিত হন এই আন্দোলনের সবচেয়ে নির্মল কণ্ঠস্বর হিসেবে। তাঁর মৃত্যু আমাদের চোখে জল আনে, আবার সেই জলেই আগুন জ্বলে ওঠে। এটা আমাদের জুলাই বিপ্লব যেখানে নাজমুল কাজীর মতো মানুষদের মৃত্যু দিয়ে লেখা হয় মানুষের মুক্তির নতুন মানচিত্র। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের জুলাই, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অদ্ভুত ঋতু, যেখানে বৃষ্টি হয়নি, হয়েছে রক্তপাত। বাতাসে লেগে ছিল আগুনের গন্ধ, আর মাটির নিচে জমে উঠছিল দীর্ঘদিনের অন্যায় আর অপমানের শিকড়। এই মাস, এই সময়, ছিল শুধু একটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের চেতনায় সীমাবদ্ধ নয় এটি ছিল এক নীরব অভ্যুত্থান, এক গণজাগরণ, যেখানে হাজার হাজার ছাত্র, ছাত্রী, শ্রমজীবী, মা, ভাই, প্রতিবেশী সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা তাদের কণ্ঠরোধ করেছে বছরের পর বছর। কোটা সংস্কার এই শব্দটি যেন একটি আলিবাবার গুপ্ত দরজা হয়ে খুলে দিয়েছিল দেশের সবচেয়ে গভীর ক্ষতগুলো। বঞ্চনা, বৈষম্য, বিচারহীনতা এসব শব্দ এতদিন কাগজে ছিল, গবেষণায় ছিল, চায়ের কাপে ছিল। কিন্তু জুলাইয়ের সূর্য তাদের রূপ দিল রাজপথে, রক্তে, এবং মানুষের চিৎকারে। ঢাকা থেকে দিনাজপুর, খুলনা থেকে কক্সবাজার সবখানে একি সুর: “আর না।” এই সুর ছিল না কোনো দলের, ছিল জনতার; এই মিছিল ছিল না কোনো একক দাবি পূরণের, ছিল একটি জাতিকে মানুষে পরিণত করার জন্য। ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের সামনের সেই প্রান্তটি তখন যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। ক্লান্ত, রক্তাক্ত ছাত্রদের শরীরে তখন চিকিৎসার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল একটু জলের। কেউ কাউকে চিনত না, সবাই শুধু একে অপরের চোখে নিজেদের প্রতিবিম্ব খুঁজছিল। এবং ঠিক তখনই, সেই মুহূর্তে, এক অচেনা মানুষ নাজমুল কাজী পৌঁছে যান সেই জায়গায়। তাঁর হাতে ছিল একটি পানির বোতল, মনেপ্রাণে একটি সহজ বিশ্বাস: "এই তৃষ্ণার জবাব পানি ছাড়া হয় না।" কিন্তু রাষ্ট্র যখন পশুর মতো আচরণ করে, তখন সহানুভূতিও হয়ে ওঠে অপরাধ। সেই এক ফোঁটা পানি নাজমুলের জীবনের শেষ কাজ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে চিনত না কেউ, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না, কিন্তু তিনি ছিলেন মানুষের পক্ষে, সত্যের পক্ষে। স্বৈরতন্ত্রের চোখে সেটিই ছিল সবচেয়ে বড় অপরাধ। স্নাইপারের ঠান্ডা নিশানায় বিদ্ধ হয়ে, তিনি সেই দিন, সেই জায়গাতেই ঢলে পড়েন। তাঁর পাশে কেউ ছিল না, শুধু একটা ফাঁকা বোতল আর একটি স্পষ্ট বার্তা: "মানবতা আজও জীবিত ছিল, যতক্ষণ না আপনারা গুলি করলেন।" এই ঘটনা ছিল না শুধু একটি মৃত্যুর বর্ণনা এটি ছিল একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখোশ খুলে ফেলার মুহূর্ত। যে সরকার একজন সাধারণ মানুষকে শুধু পানি দেওয়ার জন্য হত্যা করতে পারে, তার অধীনে কেউ নিরাপদ নয়। আর এখানেই আন্দোলনের প্রকৃত রূপ, এটি ছিল শুধু কোটা নিয়ে নয়, ছিল অস্তিত্ব নিয়ে, ছিল আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধার নিয়ে। নাজমুল কাজী সেই আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন একজন অ-রাজনৈতিক মানুষ, যিনি হয়ে গেলেন গণতন্ত্রের শহীদ। তাঁর মৃত্যু আমাদের চোখে পানি আনে, ঠিক, কিন্তু সেই পানির ভেতরেই এখন ক্রোধের আগুন লুকিয়ে আছে। শহীদ হওয়ার কাহিনি ১৮ জুলাই, ২০২৪। বিকেলটা ছিল অস্বাভাবিক গুমোট, আকাশে ছিল না মেঘ, কিন্তু বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের আগুনে। শনির আখড়া কাজলার সেই রাজপথ এখন আর কোনো রাস্তা নয় এটা ছিল এক অনাড়ম্বর যুদ্ধক্ষেত্র। হেলমেটধারী বাহিনী দাঁড়িয়ে ছিল সারি বেঁধে, পেছনে লুকানো ঘৃণার ট্রিগার। সামনে ছিল ছাত্ররা কারো হাতে প্ল্যাকার্ড, কারো হাতে ব্যান্ডেজ। কারো চোখে গ্যাস, কারো মুখে কফ। বিক্ষোভ আর বুলেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একটা অদৃশ্য প্রশ্ন এই দেশ কার? এই রক্তাক্ত মঞ্চে নাজমুল কাজী ছিলেন একমাত্র চরিত্র, যিনি অস্ত্র নিয়ে আসেননি, শ্লোগানও নয়। তিনি এসেছিলেন হাতে ঠান্ডা পানি নিয়ে তৃষ্ণার বিরুদ্ধে, নিঃশ্বাস নিতে চাওয়া কিছু মুখের পক্ষে। তাঁর চোখে ছিল না কোন রাজনৈতিক রঙ, কাঁধে ছিল না কোনো ব্যানার। শুধু মানবতা নামের এক প্রাচীন ধর্মের অনুসারী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আহতদের পাশে। কিন্তু তেমন মানবতা, এই রাষ্ট্রে ভয়ংকর অপরাধ। তাই তাঁকে ডাকা হয়নি তবু তিনি গিয়েছিলেন। কেউ বাধ্য করেনি তবু তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। আর ঠিক সেখানেই, তাঁর পবিত্র মাথায় নামে সেই ঘূর্ণির মতো এক আঘাত বলা হয়, লাঠি নয়, ছিল ধাতব কিছু, ভারী, নির্মম। তাঁর মাথা ফেটে যায়, রক্ত ছিটকে পড়ে সেই মাটিতে, যেখানে কিছুক্ষণ আগেও তিনি পানি দিচ্ছিলেন। কেউ তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি কারণ সহানুভূতি আজকাল কাউকে শক্তি দেয় না, বরং নিঃস্ব করে। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত নেওয়া হয় হাসপাতালে যেখানে তাঁকে একটি বেডও দেওয়া হয়নি। ফাইল হারিয়ে যায়, নাম খুঁজে পাওয়া যায় না, আবার পাওয়া যায় কিন্তু ততক্ষণে রক্তক্ষরণে থেমে গেছে একটি হৃদয়ের স্পন্দন। মৃত ঘোষণা করে লেখা হয়: “নাজমুল কাজী, নিহত” এই দুই শব্দে শেষ হয়ে যায় একটি বিশাল দর্শনের জীবন। তাঁর মৃত্যুর বিচার হয়নি, আর হবেও না, কারণ এই মৃত্যু কোনো আইনের আওতায় পড়ে না। এটি সেই ধরনের মৃত্যু, যা ঘটতে দেওয়া হয়; যাতে করে অন্যরাও বোঝে “তুমি পানি দাও, আমরা তোমাকে রক্তে ভাসিয়ে দেব।” এমন মৃত্যুতে কোনো ধ্বংস নেই, শুধু এক অন্তঃসারশূন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার নগ্ন প্রদর্শনী আছে। এই মৃত্যু শুধুই এক ব্যক্তির নয়। এটি একটি আদর্শের, একটি সংস্কৃতির, একটি ভাষার মৃত্যু যেখানে ভালো মানুষরা ভয় পায়, নিরপরাধেরা লক্ষ্যমাত্রা হয়, আর মানবতা নিজেই হয়ে পড়ে অপরাধ। নাজমুলের নিঃশব্দ জলদানের অভিপ্রায় আজ আমাদের চিৎকারে রূপ নিচ্ছে। আমরা বলি না “তিনি একজন বীর।” আমরা বলি “তিনি ছিলেন মানুষ, আর সেটাই তাঁর অপরাধ।” এই মৃত্যু আমাদের গলায় একটা স্থায়ী ক্ষতের মতো থেকে যাবে। প্রতি বার আমরা পানি দেবো, মনে পড়বে একবার এক নাজমুল ছিল, যিনি তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে নিজেই চিরতরে নিঃশেষ হয়ে গেলেন। শহীদের পরিবার ও তাদের বেদনা নাজমুল কাজীর মৃত্যু শুধু একটি মানুষের হারিয়ে যাওয়া নয়, এটি ছিল একটি আশ্রয়ের বিলুপ্তি। তাঁর মৃত্যু যেন এক শূন্যতার কুপ, যা প্রতিদিন গিলে নিচ্ছে একেকটি মানুষের ভেতরের আলো। এখন তাঁর স্ত্রী মারিয়া সুলতানা একটি নাম, একটি অস্তিত্ব নীরব এক সৈনিকের মতো বেঁচে আছেন, কিন্তু যেন কেবলই একটি ছায়া। নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ, অথচ অসম্ভব দৃঢ়। বুকের গভীরে যন্ত্রণার ঢেউ, কিন্তু চোখে জল নেই কারণ ছোট্ট মেয়েটি আরিয়ানা এখনো বোঝে না তার কান্না। “আব্বু” শব্দটা সে এখনো সঠিকভাবে বলতে শেখেনি, তবু তার মনে গেঁথে গেছে এক অপূর্ণতা এই নামে আর কেউ দরজায় আসে না, তাকে কোলে তোলে না, কিংবা রাতে ঘুম পাড়াতে চুমু খায় না। মারিয়া বলেন, “সে কখনও রাজনীতি করেনি। বাড়ি আর বাজার ছিল ওর রাজনীতি, বাচ্চার দুধ আর মা-বাবার ওষুধ ছিল ওর সংগ্রাম।” আর এখন? এখন তাঁর সংগ্রাম প্রতিটি সকালে উঠে বাঁচা, প্রতিটি রাতে কাঁদতে গিয়েও সংযত থাকা কারণ ঘরে যে আরেকটি প্রাণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, বুঝে না কিছু, তবুও সব অনুভব করে। পিতা সেলিম কাজী মাটির মানুষ, চাষাবাদের মানুষ এই বৃদ্ধ কণ্ঠে এখন প্রতিধ্বনি হয় কেবল একটি বাক্য, “ও তো শুধু পানি দিতেছিলো!” এই বাক্যটি ঘুরে বেড়ায় পুরো গ্রামে, বয়ে আনে স্তব্ধতা। যেখানেই যান, কেউ না কেউ বলে ওঠে, “নাজমুল ভাই? আহা, কী শান্ত মানুষ ছিলেন!” এক নিঃশব্দ কষ্টে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চারপাশ। প্রতিবেশীরা জানায়, নাজমুল ছিল একজন পরিশ্রমী, ভদ্র, হাসিমাখা মানুষ যার হাতে সবসময় কাজ থাকতো, আর চোখে থাকতো পরিবারের স্বপ্ন। তিনি কোনোদিন উচ্চবাচ্য করেননি, রাজনীতি তো দূরের কথা। তবুও, এই নিরীহ মানুষটি শহীদ হলেন। শুধু একজন আহত ছাত্রকে পানি দিতে গিয়েছিলেন এইটুকু সহানুভূতি দিয়েই রাষ্ট্রের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন এক ‘হুমকি’। এই পরিবার আজ সাহায্যপ্রার্থী নয়; তারা কেউ এসে চাল বা টাকা চায় না। তারা শুধু একটি প্রশ্ন রাখে রাষ্ট্রের মুখোমুখি: এই দেশ কি এমন জায়গা হয়ে গেছে, যেখানে সহানুভূতি রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে যায়? যেখানে বোতলভরা পানি বিপ্লবী অস্ত্র, আর ভালো মানুষরাই প্রথমে নিহত হয়? এই পরিবার প্রতিদিন বাঁচে, কিন্তু মৃত্যু ছুঁয়ে থাকে তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে। একটি শিশুর জীবনে প্রথম শোক হয়ে নাম লেখানো পিতা, একটি স্ত্রীর জীবনে অসমাপ্ত জীবনের গাথা হয়ে থাকা স্বামী, আর এক পিতার চোখে বেঁচে থাকা সেই মুহূর্ত যেখানে গর্জে ওঠে এক রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা। শহীদের উত্তরাধিকার ও প্রস্তাবনা নাজমুলের মৃত্যু একটি রাষ্ট্রের নৈতিক দেউলিয়াপনার দলিল, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া পরিবার আজ সেই দায়ের প্রকৃত সাক্ষী। একজন কন্যাশিশু আরিয়ানা কাজী যার এখনো উচ্চারণই সম্পূর্ণ হয়নি, অথচ জীবনের প্রথম পাঠেই শিখেছে “পিতা” শব্দ মানে শুধু এক মুখ নয়, এক অভাবও। এই শিশুর শৈশব এখনো জেগে আছে সেই প্রশ্নের ভেতর, “আব্বু কোথায়?” কিন্তু তার জন্য রাষ্ট্রের কোনো পাঠ্যবই নেই, নেই কোনো আশ্বাস। আরিয়ানার শিক্ষা, পুষ্টি ও ভবিষ্যৎ এটি কেবল একটি দয়ার বিষয় নয়, এটি একটি জাতির সম্মান রক্ষার প্রশ্ন। এই দেশ যদি শহীদদের স্মরণ করে মিছিলে, পতাকায়, ব্যানারে, তবে শহীদদের সন্তানদেরও স্মরণ রাখতে হবে নীতিতে, ন্যায্যতায়, বাস্তবে। তাঁর জন্য একটি মাসিক সহায়তা চালু করা আবশ্যক না দানে নয়, ঋণে নয়, বরং প্রাপ্য হিসেবে। কারণ সে একজন শহীদের উত্তরাধিকারী, আর তার ওপর এই দেশ ও সমাজের একটি ঋণ বর্তায় যা এখনো শোধ হয়নি। অন্যদিকে, মারিয়া সুলতানা এই নামটি এখন কেবল একজন বিধবার নয়, একজন প্রতিরোধকারীর প্রতীক। তিনি কান্না নয়, কাজ চেয়েছেন। যদি তাঁকে একটি সেলাই মেশিন দেওয়া হয়, তবে তিনি ভিক্ষার অপেক্ষা করবেন না, বরং সেলাইয়ের সুতো দিয়ে বুনবেন নতুন জীবনের গল্প। তাঁর আত্মসম্মান রক্ষা করা কেবল মানবিকতা নয়, এটি আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, ও নৈতিক দায়িত্ব। এই পরিবার যেন নিঃশব্দ কান্নার গল্প না হয়, বরং সহানুভূতির উত্তরাধিকার হয় তারা যেন শুধু “শহীদের পরিবার” হয়ে না থাকে, বরং হয়ে ওঠে সাহসের প্রতীক, মানবতার এক জীবন্ত দলিল। আমরা যদি চাই, যে আগামী প্রজন্ম শহীদদের সম্মান করে, তবে তাদের উত্তরাধিকারীদেরও আমাদের ভালোবাসা, নিরাপত্তা, ও সম্মান দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। নাজমুল কাজী ছিলেন এক নিরীহ পুরুষ, হাতে বোতল, মনে সাহস। এখন তাঁর উত্তরাধিকার এক কন্যা, এক স্ত্রী, আর একটি জাতির দায়। আমরা যদি আজ নীরব থাকি, তবে আগামীকাল আরিয়ানারা কাকে বিশ্বাস করবে? কার ইতিহাস পড়বে? এই প্রস্তাবনা কেবল একটি পরিবারকে রক্ষা করার আহ্বান নয়। এটি একটি জাতিকে প্রশ্ন করছে তোমরা কাদের স্মরণ করো, আর কাদের ভুলে যাও? এক নজরে শহীদ পরিচিতি নাম : নাজমুল কাজী জন্ম : ০১/০১/১৯৯৫ পেশা : ব্যবসায়ী স্ত্রী : মারিয়া সুলতানা সন্তান : আরিয়ানা কাজী নুজাইরাহ পিতা : সেলিম কাজী (কৃষক) মাতা : নাজমা বেগম বর্তমান ঠিকানা : মোহাম্মদ বাগ চৌরাস্তা, কদমতলি, ঢাকা স্থায়ী ঠিকানা : দৌলতপুর, মুরাদনগর, কুমিল্লা শহীদ হওয়ার স্থান : সোনিয়াখাড়া, কাজলা তারিখ ও সময় : ১৮ জুলাই, ২০২৪ শহীদ হওয়ার প্রেক্ষাপট : পানি খাওয়াতে গিয়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দাফন : নিজ গ্রামে, দৌলতপুর, কুমিল্লা

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: নাজমুল কাজী
Image of মো: নাজমুল কাজী

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: আহসান হাবিব

মো: কামরুল মিয়া

মো: নিশান খান

মো: ইফাত হাসান খন্দকার

 মো: শহীদুল ইসলাম

ইশতিয়াক আহমেদ

মো: সাগর

মো: ইমরান

জামসেদুর রহমান জুয়েল

মো: সাজ্জাদ হোসাইন ( সাব্বির )

মো: মাহিন

শাহিনুর বেগম

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo