জন্ম তারিখ: ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : চাকুরীজীবি ও ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ি
মো. সাইফুল ইসলাম শান্ত ছিলেন এক স্বপ্নবাজ তরুণ, একজন সমাজ সচেতন নাগরিক, একজন স্নেহপরায়ণ পিতা, একজন দায়িত্ববান স্বামী, এবং একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। যিনি জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সাদামাটা, সততার পথ বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, ঢাকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন এই সাহসী তরুণ। জন্ম থেকেই শান্তর স্বভাব ছিল শান্ত, ভদ্র ও পরোপকারী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড-১ এর বুড়িরমোড়, মিরহাজিরবাগে হোল্ডিং-১১৩/ক-তে ছিল তাঁর স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন চাকরিজীবী এবং পাশাপাশি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গাজীপুরের “মানহা নিটিং ফ্যাক্টরি”তে কর্মরত ছিলেন তিনি। শান্তর পিতা আব্দুল মতিন একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী এবং মা নিলুফা আক্তার একজন আদর্শ গৃহিণী। তাঁদের পরিবারে ভালোবাসা, সততা ও দায়িত্ববোধ ছিল প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত মূল্যবোধ। শান্ত নিজেও এ পরিবারের আদর্শের ধারক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ফাল্গুনী ইয়াসমিন ঝুমা বিবিএ করছেন এবং বর্তমানে সংসার ও সদ্যজাত সন্তানের লালন-পালনে নিযুক্ত। জীবনদর্শন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সাইফুল ইসলাম শান্ত ছিলেন সমাজের অসহায় ও প্রান্তিক মানুষের জন্য এক নিরব ভরসা। নিজেকে কখনো প্রচারের আলোয় আনেননি, বরং মানুষের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিতেন নিভৃতে। তার বন্ধুরা বলতেন, “শান্তর হৃদয় ছিল দরজা খোলা এক ঘর, যেখানে যে কেউ আশ্রয় নিতে পারতো।” বন্ধুদের সাথে তিনি ছিলেন প্রাণখোলা, পরিবারের প্রতি ছিলেন নিবেদিত, এবং দেশের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অটুট, আপোষহীন। ২০২৪ সালের গণবিপ্লব ও শান্তর স্বপ্ন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচিত হয়। দীর্ঘকাল ধরে চলা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শুরু হয় গণআন্দোলন। মানুষের অন্তরে জ্বলে ওঠে প্রতিরোধের আগুন। জনতার দাবিতে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন। এই গণজাগরণ ছিল শান্তর স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশের প্রথম দীপ্ত পদক্ষেপ। তিনি বিশ্বাস করতেন এ দেশ হবে একদিন ন্যায়ভিত্তিক, শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক। তার চোখে ছিল নতুন সূর্য ওঠার আশা, বুকভরা ছিল সাহস। ভুল বোঝাবুঝির নির্মম পরিণতি ৫ আগস্ট ২০২৪, সময় বিকাল ৪:৩০ মিনিট। শান্ত একটি ফোন কল পেয়ে বাসা থেকে বের হন। তখন কেউ জানতো না, এটাই হবে তাঁর জীবনের শেষ প্রস্থান। কিছুক্ষণ পর পরিবারের কাছে আসে বিভীষিকাময় খবর শান্ত যাত্রাবাড়ি এলাকায় গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। বড় ভাই ও একমাত্র বোনের জামাই দ্রুত ছুটে যান। তাঁরা জানতে পারেন, শান্তকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঢামেকে গিয়ে কর্তব্যরতরা জানান ‘সাইফুল ইসলাম শান্ত’ নামে কেউ ভর্তি হননি। পরে নির্দেশনা দেওয়া হয় লাশের সারিতে খোঁজ নিতে। সেখানে পরিবারের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক নির্মম দৃশ্য রক্তাক্ত, বিকৃত, নিথর শান্ত। যে মানুষটি জীবন ভরে হাসতেন, সে মানুষটি আজ চিরনির্বাক। জানা যায়, উত্তেজিত কিছু আন্দোলনরত ছাত্র ভুলবশত শান্তকে শাসকপন্থী ভেবে পিটিয়ে হত্যা করে। কাছের মানুষের স্মৃতিচারণা শান্তর শৈশবের বন্ধু ফাহিম বলেন: "শান্ত ছিল এমন একজন মানুষ, যার মতো হৃদয় খুব কম মানুষ পায়। সে কাউকে সাহায্য করতে কখনো না বলেনি। ওর চোখে সবাই ছিল পরিবার। শান্তর মৃত্যু শুধু একজন মানুষের নয়, একটি আদর্শের মৃত্যু।” পরিবারের বর্তমান অবস্থা শান্তর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ফাল্গুনী ইয়াসমিন ঝুমা এখন শ্বশুরবাড়িতে এক বছরের সন্তান মোহাম্মদ জাওয়াদকে নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছেন। শান্ত রেখে গেছেন পারিবারিক সম্পদ, নিজস্ব বাড়ি এবং ব্যবসা থেকে সামান্য কিছু আয়। তবে অর্থই সব নয়। শান্তর অভাব পূরণ করা যায় না কোনো সম্পদ দিয়ে তার জায়গায় নেই সেই ভালোবাসা, সাহস ও নৈতিক দৃঢ়তা। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি আহ্বান শহীদ মো. সাইফুল ইসলাম শান্তের আত্মত্যাগ যেন বিস্মৃত না হয়। তাঁর স্মৃতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। চিরশ্রদ্ধাঞ্জলি সাইফুল ইসলাম শান্ত ছিলেন সেই যোদ্ধা, যিনি যুদ্ধ করতেন শব্দহীনভাবে। তাকে কেনা যায়নি, তাকে ভাঙা যায়নি, তাকে দমানো যায়নি। তিনি এখন আর নেই, কিন্তু তাঁর রক্তে লেখা গল্প থাকবে এই মাটির প্রতিটি কণায়, প্রতিটি প্রতিবাদে, প্রতিটি নতুন সূর্যোদয়ে। শহীদ শান্ত, তোমার রক্ত বৃথা যাবে না। তুমি আছো, থাকবে এ দেশের প্রতিটি ন্যায়প্রেমী হৃদয়ে। প্রস্তাবনা ১. শান্তর পরিবারকে রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রদান করা হোক। ২. স্ত্রীকে উচ্চশিক্ষা অব্যাহত রাখার জন্য শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হোক। ৩. সন্তানের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ ও শিক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হোক। ৪. শান্তর নামে একটি রাস্তা, স্কুল বা স্মৃতিফলক স্থাপন করে তাঁকে স্মরণীয় করা হোক। এক নজরে শহীদ পরিচিতি শহীদের পূর্ণ নাম : মো: সাইফুল ইসলাম শান্ত জন্ম তারিখ : ০৩-০৯-১৯৯৮ জন্মস্থান : ঢাকা পেশা : চাকুরীজীবি ও ব্যবসায়ী কর্মরত প্রতিষ্ঠানের নাম : মানহা নিটিং ফ্যাক্টরি, গাজীপুর স্থায়ী ঠিকানা : হোল্ডিং-১১৩/ক, বুড়িরমোড়, মিরহাজিরবাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি, ওয়ার্ড -১, ঢাকা বর্তমান ঠিকানা : হোল্ডিং-১১৩/ক, বুড়িরমোড়, মিরহাজিরবাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি, ওয়ার্ড -১, ঢাকা বিশেষ কৃতিত্ব : সক্রিয় সমাজকর্মী, সদা হাসোজ্জল পিতার নাম : মো: আব্দুল মতিন, পেশা ও বয়স: ব্যবসায়ী, ৬০ মায়ের নাম : নিলুফা আক্তার, পেশা ও বয়স: গৃহিনি, ৪৮ মাসিক আয় : ৩০,০০০, আয়ের উৎস: চাকরি ও ব্যবসা স্ত্রী : ফাল্গুনী ইয়াসমিন ঝুমা, বয়স: ২৪, শিক্ষাগত যোগ্যতা: বিবিএ (চলমান), পেশা: গৃহিনি পরিবারের সদস্য: মোহাম্মাদ জাওয়াদ (১), ছেলে ঘটনার স্থান : যাত্রাবাড়ি আক্রমণকারী : ভুল বুঝে আন্দোলনরত ছাত্রদের গণপিটুনি আহত হওয়ার তারিখ : ৫/৮/২৪, সময়: বিকাল ৫টা মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ৫/৮/২৪, বিকাল ৫:৩০টা (আনুমানিক) শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : পারিবারিক কবরস্থান (মীরহাজিরবাগ বড়বাড়ি কবরস্থান)