জন্ম তারিখ: ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা:কম্পিউটার প্রশিক্ষক, শাহাদাতের স্থান : গোপীবাগ ভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন
মো. রফিকুল ইসলাম এর জন্ম ২৪-১২-১৯৭৩ সালে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার সাতকাছিমা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত আব্দুল জব্বার সিকদার ও মাতা হাফিজা বেগম পরিবারের তিন ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম। পিতা আব্দুল জব্বার ছিলেন দিন মজুর। কাজ করতেন দর্জির। এই দর্জি পরিবারের সদস্য সংখ্যা হচ্ছে চারজন। এই দিনমজুর পরিবারেই বেড়ে ওঠেন শহীদ রফিকুল ইসলাম। তিনি পরিবারের প্রথম সন্তান। দেশবিখ্যাত ঢাকা কলেজ থেকে তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ছোটবেলা থেকেই বিনয়ী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। মানুষ হিসেবে ছিলেন পরোপকারী। যথেষ্ট মার্জিত স্বভাব ছিল তার। ছাত্র হিসেবেও ছিলেন মেধাবী। পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষ কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে। এই স্বপ্নবাজ রফিকুল ইসলাম ঢাকায় আসেন ৩০ বছর আগে। ওয়ারি থানাধীন গোপীবাগ এলাকার মমতাজ ভিলার ৮৯/১২র দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটা ফ্লাটে তিনি ভাড়া থাকতেন। রফিকুল ইসলাম পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুইজন। স্ত্রী গৃহিণী এবং ছেলে রায়হান ইসলাম তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় আলিম ২য় বর্ষে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী। শহীদের পিতা আব্দুল জব্বারের দুই সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান বাবার পেশা অর্থাৎ দর্জি পেশা বেছে নেন। তৃতীয় সন্তান বেছে নেন কীটনাশক ব্যবসা। আর একমাত্র মেয়ে বিবাহিতা। আল্লাহর ডাকে শহীদ রফিক যেভাবে সাড়া দিলেন ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। উক্ত পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৭ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৬ ডিসেম্বর ২০২১ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ২০২৪ সালের ৫ জুন বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পরিপত্র বাতিল করে রায় দেন। ৬ জুন ২৪ হাইকোর্টের রায় বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন করলে চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেন। সেই দিনই কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পহেলা জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে সংগঠন জন্ম নেয় এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্র সমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ৪ জুলাই সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিষয়ে কোনো শুনানি না করে আপিল বিভাগ নট টুডে বলে আদেশ দেন। পরের দিন আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ক্লাস পরীক্ষা বর্জন ছাত্র ধর্মঘট পালন ও সারাদেশে বাংলা ব্লকেডের ডাক দেয়। ১৩ জুলাই সকল গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্টপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং পরের দিন জরুরী ভিত্তিতে জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম বেধে দেয়া হয়। ১৫ তারিখ বিক্ষোভ কর্মসূচির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়ালে কোটা আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগ ও ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টের দলের দোসররা ছাত্রদের উপর নির্বিচারে হামলা চালায়। এতে আন্দোলনে অবস্থানরত শিক্ষার্থী যারা ছিলেন অনেকেই আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও পিজিতে ভর্তি হয়। হাসপাতালেও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আহতদের ওপর আবার হামলা চালায়। ১৬ জুলাই দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আশেপাশের কলেজ স্কুল বন্ধের ঘোষণা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ছয় জেলায় বিজিবি মোতায়ন করা হয়। সারাদেশে ৬ জন নিহত হয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে ফ্যাসিস্ট দোসর পুলিশ হত্যা করে। ১৭ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিনের নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা চলাকালে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। পরের দিন সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি এবং সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। একযোগে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা। সেইদিন রাজধানীতে ব্যাপক সংঘর্ষ হামলা ভাঙচুর গুলি অগ্নিসংযোগ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গোপীবাগ এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছিল। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শহীদ রফিকুল ইসলাম একজন নিয়মিত মুসল্লী হিসেবে এবং মুত্তাকী হওয়ায় ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে প্রতিদিনের মতো সেদিনও গোপীবাগ এলাকার এলাহী মসজিদে এশার নামাজ পড়তে নিজ বাসা থেকে যান। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কে জানতো এটাই তার জীবনের শেষ নামাজ হয়ে যাবে। মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা শহীদ রফিকুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যায়। গুম করেই নরপিশাচরা ক্ষান্ত হয়নি। তারা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে চার থেকে পাঁচটি গুলি চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত হলে লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। অপরদিকে শহীদের পরিবার দিক বিদিক ছুটাছুটি করেও পরিবারের একমাত্র অবলম্বন শহীদ রফিকুল ইসলামকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। থানায়, হাসপাতাল, ক্লিনিক থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ পর্যন্ত বারবার ছুটে গিয়েও হতাশ হয়ে তাদের ফিরে আসতে হয়েছে। কে জানতো এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণের শিকার হতে হবে এই পরিবারকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে শহীদের পরিবার জানতে পারে ২৪ জুলাই ২৬ টি লাশ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের রায়েরবাজার মোহাম্মদপুর কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। চিরতরে এভাবেই নিভে যায় একটি ফুটন্ত গোলাপ। একটি পরিবারের কর্ণধার। শহীদ সম্পর্কের নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর মন্তব্য শহীদ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এর বন্ধু গালিব টেলিকম সেন্টারের কর্ণধার এর ভাষ্যমতে শহীদ রফিকুল ইসলামের সাথে ২৫ বছরের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। শহীদ রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একজন সক্রিয় রোকন প্রার্থী ছিলেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। নিয়মিত কুরআন পড়তেন। হাদিসের চর্চা করতেন। নিয়মিত মসজিদে জামাআতে নামাজ আদায় করতেন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সবসময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে এলাকার কারো কোনো শত্রুতা নেই। রাজনৈতিকভাবে তাকে আওয়ামী লীগের লোকজন প্রতিপক্ষ বলে মনে করত। তিনি তার বন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন এবং সরকারের কাছে এই সহায়তা ও অসচ্ছল পরিবারের সহায়তা দাবি করেন। মো: খোরশেদ আলম (শহীদের বন্ধু) ব্যক্তিগত প্রোফাইল পুরো নাম : মো: রফিকুল ইসলাম জন্মতারিখ : ২৪-১২-১৯৭৩ সালের পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার সাতকাছিমা গ্রাম স্ত্রী : গৃহিণী পারিবারিক সদস্য : ২ জন পরিবারের মাসিক আয় : ২০ হাজার টাকা ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা : এক ছেলে ১) ছেলে : রায়হান ইসলাম। তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা আলিম দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত পেশা : দক্ষ কম্পিউটার প্রশিক্ষক স্থায়ী ঠিকানা : পিরোজপুর জেলার, নাজিরপুর থানার সাতকাছিমা ইউনিয়নের, সাতকাছিমা গ্রামের বাসিন্দা বর্তমান ঠিকান : ৮৯/১২, মমতাজ ভিলা, গোপীবাগ এলাকা, ওয়ারী থানা, ঢাকা ঘটনার স্থান : গোপীবাগ ভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাহী মসজিদের সামনে আঘাতকারী : পুলিশ ও ছাত্রলীগ যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের দ্বারা আহত হওয়ার সময় কাল : ১৯ জুলাই ২০২৪, রাত ৯ টা নিহত হওয়ার সময়কাল, স্থান : ১৯ জুলাই ২০২৪, রাত ১২:১০ মিনিট শহীদের কবরে বর্তমান অবস্থান : রায়েরবাজার কবরস্থান, মোহাম্মদপুর