Image of শাহরিয়ার হোসেন রোকন

নাম: শাহরিয়ার হোসেন রোকন

জন্ম তারিখ: ২৭ জানুয়ারি, ২০০১

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: ডেলিভারি বয়, শাহাদাতের স্থান : ময়ুর ভিলা সড়ক, মোহাম্মদপুর সড়ক

শহীদের জীবনী

শহীদ শাহরিয়ার হোসেন রোকন একটি নাম একটি ইতিহাস। তিনি ২০০১ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জনাব মনির হোসেন একজন দিনমজুর। তার মা মোসা: রাবেয়া বেগম ছোট-খাট একটি চাকরি করেন। পিতা-মাতার বড় সন্তান শহীদ শাহরিয়ার। দরিদ্রতার কারনে অল্প বয়সেই পড়াশোনা ছেড়ে ডেলিভারি বয়ের চাকরি নেন। তাদের নিজস্ব কোন বাড়ি নেই। তাই তাদের ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। শহীদ রোকন বেতন পেতেন তার অর্ধেক বাসা ভাড়া দিতে চলে যেত। বাকি টাকা দিয়ে কোনমতে ডাল-ভাত খেয়ে পরিবারের সাথে কোনোরকমে দিন পার করতেন শহীদ শাহরিয়ার হোসেন। পরিবারে তাঁর আরও ২ টা ভাই আছে। ছোট ভাই তামজিদুল ইসলাম কাঠমিস্ত্রীর কাজ শিখছেন আরেক ছোট ভাই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে জীবন দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান শহীদ শাহরিয়ার হোসেন রোকন। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে তোলা থাকবে তাঁর নাম। তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনড়। সততা ও ন্যায়ের প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। দরিদ্রতার কারনে ডেলিভারির বয়ের কাজ করেন কিন্তু কখনো কোন অন্যায়ের কাজের সাথে জড়িত হননি। সততাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রতিবেশীর কাছে ছিলেন আদর্শের প্রতীক। কারও সাথে কখনো কোন কটু কথা বলেননি। সবার সাথে মিলেমিশে থাকতেন। কারও বিপদ আপদ দেখলে দৌড়ে যেতেন। যেভাবে তিনি শাহাদাতের মালা গলায় পড়লেন ২০০৮ সালে এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ। দলের প্রধান হিসেবে সরকার হন শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় এসেই শুরু করেন নানান অরাজকতা। বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে পিলখানা ট্র্যাজেডি ঘটান। যেখানে নিহত হয় ৫৭ জন চৈৗকস সেনা অফিসারসহ অসংখ্য সেনা ও বিডিআর সদস্য। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামি ১৩ দফার দাবীতে একত্রিত হয়। তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে পাখির মত হত্যা করে অসংখ্য হেফাজত কর্মীকে। ঘটনা ধামাচাপা দিতে রাতের আধারে লাশ গুম করে ফেলে। এরপর নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামী সরকারের সহচর ছাত্রলীগের ক্যাডাররা সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা চালিয়েছিল। সরকারের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ দিনে দিনে বেপরোয় হয়ে ওঠে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার কাছে মানুষ খুন করা ছিল ছেলে-খেলা। বিরোধী দলকে দমন করতে গুম-খুন, হত্যা, গ্রেফতার, দমন-নিপীড়ন চালায়। আয়না ঘরে বন্দী করে রেখে অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। শুধু তাই নয় ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, ঘোষ, চাঁদাবজি,সন্ত্রাসী ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। সরকারের অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থের যোগান দিতে জনগণের উপর মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ করে। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে দু:র্বীসহ করে তুলে। নিম্ন আয়ের মানুষ পরিবারের ব্যয় বহন করতে না পেরে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে গলা চেপে ধরে। জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে সমালোচনার সকল পথ বন্ধ করে দেয়। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। পরপর দুইটি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে। প্রতিটি সেক্টরে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার মাধ্যমে মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করা হয়। দলীয় কর্মীদের অবৈধভাবে সরকারের বিভিন্ন কর্মে নিয়োগ প্রদান করে। ছাত্রজনতা এসব অনাচার ও বৈষম্য মেনে নিতে পারেনি। ২০১৮ সালে ছাত্র-জনতা কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। সেখানেও ছাত্রলীগ হামলা চালায়। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নির্বাহী আদেশে কোটা প্রথা বাতিল করার কথা বললেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাইতো ২০২৪ এ এসে আবারো আন্দোলন শুরু করে ছাত্র জনতা। জনগণের মনে দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ এই আন্দোলনে এসে ফেটে পড়ে। ছাত্রদের সাথে সাধারণ মানুষও যুক্ত হয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে। অবিরাম আন্দোলন চলতে থাকে। ১৩ জুলাই ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে শাহবাগে আসে। সেখানে পুলিশ বাঁধা প্রদান করে। ছাত্র-জনতা পুলিশের বেরিকেড ভেঙে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে। ১৪ তারিখ রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতা কে রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেয়। মুহুর্তেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ছাত্রজনতা “তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার” বলে স্লোগান দিতে থাকে। পরদিন ১৫ তারিখ ছাত্র-জনতা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয়। অপরদিকে ছাত্রলীগ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উস্কানি পেয়ে লাঠিসোঁটা, রামদা, চাপাতি, হকিষ্টিক স্ট্যাম্প, লোহার রড ও দেশীয় অস্ত্র-সস্র নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ছাত্ররা যখন সমাবেশ করছিল তখন হঠাৎ করেই তারা ছাত্রজনতার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ৭১'র ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের উপর হামলা চালিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে ছাত্রলীগও ছাত্রজনতার উপর হামলা চালায়। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আহত করে। তাদের হাত থেকে নিরীহ বোনরাও রক্ষা পায় না। অনেকের মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। অনেকের হাত-পা ভেঙে দেয়। তবুও তারা থেমে থাকেনি। তারা মেয়েদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করে না। শত শত শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়। ছাত্রলীগ হাসপাতালে গিয়েও ভর্তিরত আহত শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন চালায়। ছাত্রলীগের ভয়ে পালিয়েও নির্যাতিতদের রক্ষা মেলেনি। ১৫ তারিখ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ১৬ তারিখ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এই দিনে শহীদ আবু সাইদ বুক পেতে দেয় ঘাতকের বুলেটের সামনে। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় আবু সাইদের শরীর। আবু সাইদের মৃত্যু পুরো দেশকে কাঁদিয়েছিল। ১৮ তারিখ ছাত্র-জনতা কমপ্লিট শাট ডাউন ঘোষণা করে। সেদিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ঢাকা শহর। ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশ, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ছাত্র-জনতাকে লক্ষ করে কাদাঁনে গ্যাস , রাবার বুলেট, গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। গ্রেনেডের শব্দে কেঁপে ওঠে ঢাকা শহর। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। তাদেরকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহত হয় আরও অনেকে। সারাদেশে সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। চিরুনি অভিযান চালিয়ে ঢাকার বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে নিরপরাধ ছাত্রদের ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। এসব দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষের বিবেক কেঁদে উঠে। কেউ ঘরে বসে থাকতে পারে না। সবাই যার যার জায়গা থেকে আন্দোলনে যুক্ত হয়। কেউ পানি দিয়ে, খাবার দিয়ে কেউ আবার আশ্রয় দিয়ে ছাত্রদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ১৯ জুলাই সকাল ১০ টায় শহীদ শাহরিয়ার হোসেন বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। সকাল থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। স্বৈরাচারীরের পুলিশ বাহিনী সাজোয়াজান ও আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করতে মরিয়া হয়ে উঠে। সকালের পর থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকা। সকাল থেকে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয় একটানা বিকেল তিনটা পর্যন্ত চলে এই সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, টিয়ারসেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড় পুলিশ। ছাত্র-জনতা ইট পাটকেল ছুড়ে পুলিশকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ বাহিনী অতর্কিত গুলি চালালে সেখানে ছাত্র জনতা টিকে থাকতে পারে না। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। একের পর এক সাধারণ শিক্ষার্থী গুলি বিদ্ধ হয়ে রাস্তায় মুখ থোবড়ে পড়ে । অনেকে সেন্সলেস হয়ে যায়। আহত হয় শতাধিক। মুহুর্তের মধ্যেই মোহাম্মদপুর এলাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহীদ শাহরিয়ার হোসেন গুলিবিদ্ধ মানুষকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর কাজ শুরু করে দেয়। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলির মধ্যে টিকা সম্ভব ছিল না। তিনি যখন উদ্ধার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনি অনেকগুলা ছোররা গুলি এসে তার শরীরে বিদ্ধ হয়। যে মানুষটি এতক্ষণ অন্যদের উদ্ধার করতে ব্যস্ত ছিল সেই মানুষটিই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেল। ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে মমতাজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তাররা কিছু করতে পারলেন না। তারপর তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হসপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই আনুমানিক দুপুর ১২ টার দিকে তিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারে শোকের ছায় নেমে আসে। কান্নায় ফেটে পড়ে তার দরদী মা। তাঁর বাবা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন,আর ফিরে আইব না আমার ছেলে। দাফন: বিকাল ৪ টার দিকে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। তাকে রায়ের বাজার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি সন্তানকে হারিয়ে পিতা মাতা দুজনেই পাগলপ্রায়। মায়ের অনুভূতি প্রকাশ করার মত না। পারিবারিক অবস্থা শহীদ শাহরিয়ার হোসেন রোকনেরা ৩ ভাই। তার বাবা দিনমজুর এবং মা ছোট-খাট একটা চাকরি করেন। ছোট ভাই তামজিদুল ইসলাম ও সানজিদ। তামজিদুল ইসলাম কাঠমিস্ত্রীর কাজ শিখছেন এবং সানজিদ ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। তাদের নিজস্ব কোন বাড়ি নেই। তাই ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। অনেক টাকা ভাড়া বাবদ চলে যেত। শহীদ শাহরিয়ারের আয় দিয়েই মুলত সংসার চলত। তার মৃত্যুতে পরিবার এক সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়েছেন। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : শাহরিয়ার হোসেন রোকন পেশা : ডেলিভারি বয় জন্ম তারিখ : ২৭/০১/২০০১ জন্ম স্থান : মোহাম্মদপুর, ঢাকা পিতা : মো: মনির হোসেন মাতা : রাবেয়া বেগম আহত হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪ সকাল ১১:৩০ স্থান : ময়ুর ভিলা সড়ক, মোহাম্মদপুর সড়ক শাহাদাতের তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাওয়ার পথে দাফন : রায়ের বাজার, ঢাকা

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of শাহরিয়ার হোসেন রোকন
Image of শাহরিয়ার হোসেন রোকন

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: মনিরুল ইসলাম

মো: ইমন

মোঃ মমিনুল ইসলাম রিদয়

মো: জাহিদ-এ-রহিম

মো: ইয়ামিন চৌধুরী

হাফেজ মোহাম্মদ জুবায়ের আহমাদ

মো: রমজান আলী

আবদুল্লাহ সিদ্দিক

মো: ইয়াসির সরকার

আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী

মো: জাকির হোসেন

সাজিদ হাওলাদার

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo