জন্ম তারিখ: ১ মার্চ, ১৯৯৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : শ্রমিক, শাহাদাতের স্থান : বাড্ডায় পুঁজি টাওয়ারের সামনে প্রগতি সারণি
বাংলার ইতিহাসে একবিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী গণ-ছাত্র আন্দোলনে লড়াকু সৈনিকের ন্যায় প্রতিবাদ মুখরিত হয়ে স্বৈরশাসক হাসিনার পেটোয়া বাহিনী ঘাতক পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণকারী দিনমজুর, সৎ, পরিশ্রমী শহীদ মো: সুমন সিকদার ১ মার্চ ১৯৯৩ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কবাই ইউনিয়নে অসহায় ও দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি ছিলেন একজন দিনমজুর ও শ্রমিক, কখনো একজন নির্বিকার ফেরিওয়ালা। যার দরুন অভাব অনটন সবসময় পিছুটান হয়ে জোঁকের মত লেগে থাকতো। পরিবারের মুখে দুমুঠো আহার তুলে দেওয়ার জন্য দিনমজুরের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় ভোক্তাদের নিকট চাহিদা মোতাবেক পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হাজার বর্গ মাইল জুড়ে বিস্তার লাভ করা গণঅভ্যুত্থানে দিনমজুর শহীদ মো: সুমন সিকদার এমন একজন মানুষ যিনি এই বসুন্ধরার চাকচিক্যময় ও লোভনীয় সামগ্রী উপেক্ষা করে ঐতিহাসিক আগষ্ট বিপ্লবের সময় নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে শহীদের সারিতে স্বাক্ষর রেখে আগামী প্রজন্মের তরুণ, যুবক ও খেটে খাওয়া মানব সমাজের জন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে গেছেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশসমূহ যেমন-আমেরিকা, বৃটেন, জাপান, কানাডা ছাড়াও জাতিসংঘ ছাত্র জনতার এই আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অভাব-অনটনে জর্জরিত দিনমজুর শহীদ মোঃ সুমন সিকদারের হৃদয়ে ছিল সবসময় সাদামাটা জীবন গঠনের স্বপ্ন। সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি প্রাধান্য দিতেন সততা, ন্যায়পরায়ণতা, হালাল উপার্জন আর বৈষম্যবিরোধী মানসিকতা। তারই প্রেক্ষিতে নিজ গ্রাম বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কবাই ইউনিয়নের মায়াজাল ত্যাগ করে পড়তে ও লিখতে না জানা ব্যক্তিটি পরিবারের সদস্যের অর্থের যোগান দিতে গিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। শহীদ মোঃ সুমন সিকদার কর্মজীবনে ছিলেন সৎ এবং পরিশ্রমী। ৫ আগস্ট ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানে শাহাদাত বরণকারীগণের মধ্যে শহীদ মো: সুমন সিকদার ছিলেন এমন একজন মানুষ যার ইতিবাচক গুণাবলি আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণার আঁধার হয়ে থাকবে। শহীদ মো: সুমন সিকদার আগামী প্রজন্মের সামনে তাদের জীবন-মশাল তুলে ধরার মানসে রচনা করছেন শাহাদাতের তামান্না। তাঁর হৃদয়ছোঁয়া শহীদী তামান্না বিশ্ব পরিমন্ডলে তরুণদের নিকট রোল মডেল হিসেবে সমাদৃত হয়ে বৈষম্যবিরোধী কার্যকর্মে উদীয়মান তারুণ্যের অন্তরে যথেষ্ট সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে। পরিবারের একমাত্র অভিভাবক শহীদ মো. সুমন সিকদার ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে মেঝো। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী তিনি ছিলেন মিষ্টভাষী ও মানব দরদী প্রকৃতির লোক। তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে বেড়ে ওঠা অন্যান্য সদস্যরা হলেন সোহাগ সিকদার। যার বয়স ছিল ৩৪ বছর। এছাড়াও অন্য সদস্য হলেন শামীম সিকদার। যার বয়স ছিল ২২ বছর এবং অন্য সদস্য যিনি তিনি হলেন শহীদ মো: সুমন সিকদারের একমাত্র কর্ণধার ও নিষ্পাপ শিশু আলিফ সিকদার। যার বয়স মাত্র ২২ মাস। সুমন সিকদার মাত্র ৮ম শ্রেণির গন্ডি পেরিয়ে জীবিকা নির্বাহের খোঁজে পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পড়ালেখার স্বপ্ন ছেড়ে ঢাকা বাড্ডায় পাড়ি দেন। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে অর্থ রোজগারের জন্য দিনমজুর হিসেবে কাজ করে পরিবারের হাল ধরার প্রয়াস করেন। দীর্ঘ ৩-৪ বছর তিনি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় অবস্থিত বাড্ডায় এক ভাড়া বাসায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনরকমে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি পরিবারের নিকট ছিলেন বটবৃক্ষ। দেশে বৈষম্যবিরোধী গণ ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিস্ট খুনি হাসিনা কতৃক কন্ঠরোধ, আইনের অপব্যবহার, দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিচারকার্যে অস্বচ্ছতা তথা সর্বোপরি সবকিছুর যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষেরা যখন প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠেন তখনই শহীদ মোঃ সুমন সিকদারের হৃদয় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নাম না জানা অনেকের মতো শহীদ সুমনও সামান্য শুকনো খাবার, তরল জাতীয় পানি ইত্যাদি দ্বারা সেবা প্রধানের মাধ্যমে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এমন সময় অবৈধ ফ্যাসিস্ট ও খুনি হাসিনার স্বৈরশাসকের পথভ্রষ্ট পথচলায় পরিচালিত ঘাতক পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলিতে আন্দোলনরত বাড্ডায় ফুজি টাওয়ারের সামনে প্রগতি সরণির মোড়ে শহীদ মো: সুমন সিকদার শাহাদাত বরণ করেন। যা ছিল খুবই মর্মান্তিক। পরিবারে স্ত্রী ও ২২ মাসের শিশু কন্যা সন্তানকে রেখেই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছে। সামগ্রিক ঘটনার বর্ণনা ৫ আগষ্ট ২০২৪ সোমবার দুপুর ১২.০০ টার দিকে ঢাকা বাড্ডায় ভাড়ারত বাসা থেকে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে শহীদ সুমন বেরিয়ে যান। ঐ মুহুর্তে ঢাকা শহরের সকল অলিতে-গলিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতা গণআন্দোলন অব্যহত রেখেছিল। রাস্তায় আন্দোলনরত ছাত্রদের দেখে তিনি তাদের পাশে অবস্থান নেন। নানাভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করেন। ঠিক তখনই শহীদ মো: সুমন সিকদার স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী কতৃক ঘাতক পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরলোক গমন করেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত ডাক্তারগণ তাকে মৃত ঘোষণা দেন। প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পতিত হয়ে নদী ভাঙনের কারণে একমাত্র কৃষি নির্ভর জমিজমা হারিয়ে শহরে পাড়ি জমানো দিনমজুর শহীদ মো: সুমন সিকদারের পরিবার যখন সমাজের বিদ্যমান বৈষম্য, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়ে একদমই বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল, ঠিক এমন সময় তার মৃত্যু সংবাদ পুরো পরিবারের জন্য বিপর্যয় হিসেবে আবির্ভুত হয়। একজন দিনমজুরের এই করুণ পরিণতি সমাজের অসাম্য ও বৈষম্যকে আরও প্রকটভাবে প্রকাশ করে। একনজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি নাম : মো: সুমন সিকদার জন্ম তারিখ : ০১-০৩-১৯৯৩ পিতা : মো: ইউসুফ সিকদার মাতা : মাসুমা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: কবাই, ইউনিয়ন: কবাই থানা: বাকেরগঞ্জ, জেলা: বরিশাল সন্তান : আলিফ সিকদার পেশা : শ্রমিক ঘটনার স্থান : বাড্ডায় পুঁজি টাওয়ারের সামনে প্রগতি সারণি আহত হওয়ার সময়কাল : দুপুর ১২.০০ টা শাহাদাতের সময়কাল : দুপুর ১২.০০ টা আঘাতের ধরন : বুকে গুলির আঘাত আক্রমণকারী : ঘাতক পুলিশ ও খুনি হাসিনা সরকারের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : নিজ গ্রাম কবাইতে