জন্ম তারিখ: ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : ব্যবসা (কন্সট্রাকশন মালামাল সরবরাহকারী) শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক)
"সন্তানকে খুঁজতে গিয়ে ঘরে ফেরা হলো না আর" জন্ম ব্যক্তিজীবন আব্দুল গফুর ও ছাহেরা বেগমের সংসার শুরু হয় রাজধানীর মেরাজনগরে। একে একে জন্ম নেয় হারুন (৫৬), হুমায়ন (৫১) ও শরিফুল্লাহ (৪৭)। সংসার জুড়ে চলে উৎসবের আমেজ। পিতামাতার চোখের সামনে সন্তানেরা বড় হতে থাকে। দায়িত্ব বেড়ে যায় ছাহেরা বেগমের। সন্তানদের লালন পালনে দিন-রাত পরিশ্রম করেও ক্ষান্ত হন না গফুর সাহেব। কিছুদিন পর তাদের ঘর আলোকিত করে ১৯৮২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয় শহীদ মো: মাসুদ। ব্যবসায়ী বাবার চোখেমুখে আনন্দ ফুটে ওঠে। পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনে দুরন্তপনায় মাতে শহীদের ভাইয়েরা। সে আনন্দ অচিরেই অশ্রুতে রূপ নেয়। মাত্র নয় বছর বয়সে বাবাকে হারায় মাসুদ। পরিবারে নেমে আসে যাতনা জীবন বহমান। সকল হারানো কিংবা শোক-তাপের ঊর্ধ্বেও জীবন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এটাই চিরন্তন সত্য। স্মৃতি শুধুই স্মৃতি। কিছু স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। কিন্তু স্মৃতিকে যেমন ভুলে থাকা যায় না, তেমনি অস্বীকারও করা যায় না। মানুষকে আল্লাহ অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন। সেই অসাধারণ সুন্দর নিয়ামতের একটি হলো সন্তানের জন্য তার বাবা-মা। বাবা সন্তানের মাথার ওপর স্নেহচ্ছায়া রাখেন বটবৃক্ষের মতো। বাবার তুলনা বাবাই। যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রং ও আলোর দর্শন পরিবর্তন হয়। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। বাবাকেই আদর্শ মনে করে সন্তানেরা। বাবা সন্তানকে শেখান কীভাবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। তার মৃত্যুর পর সন্তানেরা বাস্তবতা বুঝতে শেখে। জীবনের নিষ্ঠুরতা থেকে পরিত্রাণ খোঁজে। অবশেষে মেলে পরিত্রাণ বাবাকে হারিয়ে মাসুদ ও তার পরিবারের চার দিক আঁধারে নিমজ্জিত হয়, অনিশ্চিত জীবনে পদার্পণ করে সন্তানেরা। সংসারের হাল ধরতে শহীদের তিন ভাই নানা কাজে যুক্ত হন। কেউ কারখানায়, কেউ বা মুদি দোকানে, কেউ বা আবার চাকরিতে যুক্ত হন। সংসার স্বাভাবিক হতে থাকে ছাহেরা বেগমের। একে-একে সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করতে এক পর্যায়ে কুমিল্লা শহরের জায়গা-জমি বিক্রি করেন শহীদ জননী। তার চৌকস চিন্তা ধারায় অবশেষে আর্থিক অনটন থেকে পরিত্রাণ পায় শহীদ পরিবার। শহীদ মাসুদকে প্রতিষ্ঠিত করতে সকলের ঐকমত্য ভাইদের অনস্বীকার্য অবদানে মাসুদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বড় ভাই প্রবাসী, মেজ ভাই বাস চালক, সেজ ভাই একটি মেশিনারিজ কোম্পানিতে চাকরি করেন। সেজ ভাই শরীফের ভাষ্যমতে- “মাসুদ ছিল একটু ডানপিটে ধরনের। আমরা তাকে কয়েকবার প্রবাসে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে থাকতে না পেরে পরবর্তীতে দেশে চলে আসে মাসুদ।” মেরাজনগর, যাত্রাবাড়ী এলাকার পৈতৃক ভিটায় শহীদের আদি বসতি। পরবর্তীতে ভাগাভাগি হলে সন্তানদেরকে সমান ভাগে জমি বন্টন করে দেন মহীয়সী নারী ছাহেরা বেগম। ভাইদের প্রচেষ্টায় নিজ জমিতে এককক্ষ বিশিষ্ট একটি বাড়ি নির্মাণ করেন মাসুদ। তবে এক চতুর্তাংশ তার নিজ খরচে করা। বাড়ির প্লাস্টার, ছাদ ঢালাই, অসম্পূর্ণ রয়েছে। উপরে পুরাতন টিনের ছাউনি। একটু বৃষ্টি হাল তার স্ত্রী হেনা বেগম (৩৯) দুশ্চিন্তায় পড়েন। টিনের ছিদ্র দিয়ে পানি ভিতরে প্রবেশ করে। শহীদ মাসুদ পেশায় একজন মালামাল সরবরাহকারী ছিলেন। তিনি ইট, বালি, সিমেন্ট ও রড বিভিন্ন অফিস, বাসা-বাড়ীতে সরবরাহ করতেন। তবে তার নিজস্ব কোনো দোকান বা পুঁজি ছিল না। অন্যের দোকানের মালামাল তৃতীয় পক্ষ হয়ে বিক্রি এবং সরবরাহ করাই ছিল শহীদের একমাত্র পেশা। তিনি ছোট থেকে বাবার আদর, শাসন ও নিয়মমাফিক জীবন পরিচালনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে কারণে তার মধ্যে দ্বায়-দায়িত্বের পরিপক্কতা একটু কমই ছিল। মাসুদের তিনটি সন্তান রয়েছে। মাহফুজ (১১), মারুফ (৯) ও মাশরাফি (৬)। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গণ জোয়ার ঘটনার সূত্রপাত জুলাই মাসে। সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গণজোয়ার ওঠে। চারিদিকে ছাত্রদের মিছিল অবরোধে সারাদেশ যেন একত্রিত হয়। ছোট বড় সকলের মুখে উচ্চারিত হয় “স্বৈরাচার হটাও, দেশ বাঁচাও”। জোর প্রয়াগ করে ক্ষমতায় থাকতে চায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। পুলিশ, আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগ মোতায়েন করে সারাদেশে গণহত্যা চালায় খুনি হাসিনা। শহর থেকে গঞ্জের প্রতিটা অলি-গলিতে নির্বিচার গুলি চালায় তারা। রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। সাধারণ জনতাকেও ছাড় দেয়নি হাসিনার পালিত বাহিনী। যেভাবে তিনি শহীদ হন শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০২৪। চারিদিকে ব্যাপক গুলাগুলি চলে। সাধারণ জনগণ দোকানপাট বন্ধ করে নিজ বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। ঠিক তেমনি মাসুদও নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সন্তানেরা বারবার বাইরে খেলতে যাওয়ার বায়না ধরে। তাদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঘরবন্দি রাখার চেষ্টা করেন হেনা বেগম। একপর্যায়ে মেজ ছেলে মারুফ (৯) বিকাল হওয়ায় ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সাহস করে সন্তানকে খুঁজতে যায় মাসুদ। একটু পর মুয়াজ্জিনের কন্ঠে আসরের আজান উচ্চারিত হয়। শহীদ ভাবেন নামাজ আদায়ের পর মারুফকে আবার খুঁজবেন। এই ভেবে রাস্তা পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন তিনি। ‘আপনার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন।’ ঘটনার শুরু মসজিদের পাশের গলিতে যুবলীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা রামদা এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে তখন টহল দিচ্ছিল। তারা বড় বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে পথচারীর দিকে গুলি তাক করে রাখে। এমতাবস্থায় রাস্তা পার হয়ে গলিতে প্রবেশ করেন মাসুদ। হঠাৎ একটি গুলি তার কপালে এসে বিদ্ধ হয়। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেজ ভাই শরীফের কাছে স্থানীয়দের ফোন আসে। ‘আপনার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন।’ তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়েন শহীদের সহোদর। ছোট ভাইয়ের রক্তাক্ত শরীরকে নিজের হাতের উপর নিয়ে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে সিটি স্ক্যান করেন চিকিৎসকেরা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মাসুদের শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে। নিস্তেজ হয়ে যায় তার দেহ। রাত একটার দিকে পরিবারকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান শহীদ মো: মাসুদ। মেডিকেল সনদে উল্লেখ করা হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। লাশ মেরাজনগর নিজ বাড়িতে পোঁছায়। স্বামীর রক্তাক্ত জখম নিথর দেহ দেখে মুহূর্তে প্রাণনাশের উপক্রম হয় হেনা বেগমের। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পরিবার। অতঃপর শহীদ মাসুদের জানাজা সম্পন্ন হলে চিরদিনের জন্য তার লাশ মাতুয়াইল কবরস্থানে শায়িত করা হয়। “অনিশ্চয়তার বেড়াজালে বাঁধা পড়েছে বাকী জীবনের পটভূমি।” অভিভাবকহীন পরিবার মাসুদের হঠাৎ মৃত্যুতে তার স্ত্রী যেন দুঃখের সাগরে পড়েছেন। ছোট-ছোট এতিম তিন সন্তানকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা যেন গগনসম। সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসার চালানোর মতো পুঁজি শহীদ মাসুদ রেখে যাননি। হেনা বেগমের পারিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। কীভাবে সন্তানদের অনাগত ভবিষ্যৎ গড়বেন জিজ্ঞাসা করলে- অঝরে কেঁদে ওঠেন তিনি। অল্প বয়সে স্বামীর মৃত্যু যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। মাসুদ সন্তানকে খুঁজতে গিয়েছিলেন, আজ সন্তানেরা তাকে খুঁজে বেড়ায়। কোথায় খুঁজে পাবে তাদের প্রিয় বাবাকে, বলতে পারেন? শোকাহত পরিবারটি বর্তমানে নীড়হারা উদবাস্তুর মতো বিচরণ করছে! অনিশ্চয়তার বেড়াজালে বাঁধা পড়েছে বাকী জীবনের পটভূমি। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: মাসুদ পেশা : ব্যবসা জন্ম তারিখ ও বয়স : ০১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২, ৪২ বছর আহত হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, আনুমানিক বিকাল ৫টা শহীদ হওয়ার তারিখ : ২০ জুলাই ২০২৪, শনিবার, রাত ১টা শাহাদাত বরণের স্থান : মেরাজনগর, ব্লক-বি, মসজিদ সংলগ্ন দাফন করা হয় : মাতুয়াইল কবরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মেরাজনগর, এলাকা: যাত্রাবাড়ী জেলা: ঢাকা পিতা : মো: আব্দুল গফুর মাতা : ছাহেরা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : বসতি জমি রয়েছে (অসম্পূর্ণ বাড়ি) সন্তানের বিবরণ: ১. মো: মাহফুজ, সম্পর্ক: ছেলে, বয়স: ১১, প্রতিষ্ঠান: প্যারাডাইস কিন্ডার গার্ডেন, শ্রেণি: ৪র্থ ২. মো: মারুফ, সম্পর্ক: ছেলে, বয়স: ০৯, প্রতিষ্ঠান: প্যারাডাইস কিন্ডার গার্ডেন, শ্রেণি: ৩য় ৩. মো: মাশরাফি, সম্পর্ক: ছেলে, বয়স: ০৬, প্রতিষ্ঠান: মারিফুল কুরআন ইন্টা. হিফজ মাদরাসা, শ্রেণি: প্লে ভাইবোনের বিবরণ: ১. হারুন, সম্পর্ক: বড় ভাই, বয়স: ৫৬, পেশা: প্রবাসী ৩. হুমায়ন, সম্পর্ক: মেজ ভাই, বয়স: ৫১, পেশা: বাস চালক ২. শরীফুল্লাহ, সম্পর্ক: সেজ ভাই, বয়স: ৪৭, পেশা: চাকরি (গারটেক্স মেশিনারিজ) স্ত্রী : হেনা বেগম, পেশা: গৃহিণী, বয়স: ৩৭ প্রস্তাবনা : ১. শহীদের তিন সন্তান লালন পালনের জন্য মাসিক বা এককালীন ভাতা দেয়া যেতে পারে : ২. অসম্পূর্ণ বাড়ী সম্পূর্ণ করে দেয়া যেতে পারে : ৩. শহীদের স্ত্রীকে যেকোনো ধরনের ভাতা দেয়া যেতে পারে