জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : ওয়াব্দা ব্রিজ, ঢাকা-মাগুরা-রোড
শহীদ ফরহাদ হোসেন -২৪ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝরে যাওয়া একটি তরুণ প্রাণ। মাত্র ২২ বছরের ছোট্ট জীবন অথচ দেশের জন্য কী চরম আত্মত্যাগ! শহীদ ফরহাদ হোসেনের জন্ম ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি। বছরের শুরুর দিনেই ফরহাদের জন্মদিন। ফরহাদের জন্মস্থান খুলনা বিভাগের মাগুরা জেলার নাকোল ইউনিয়নের শ্রীপুর থানা, রায়নগর গ্রাম। শুধু মাগুরাবাসীর গর্ব নয় শহীদ ফরহাদ আজ দেশবাসীর গর্ব। পারিবারিক জীবন শহীদ ফরহাদের পিতা জনাব মো. গোলাম মোস্তফা (৫৮) পেশায় গাড়ি চালক। বাসের ড্রাইভার। মাসিক আয় ত্রিশ হাজারের মতো। এই অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম হওয়া ফরহাদ এখন কতটা অসাধারণ,সবার চেয়ে আলাদা। শুধু কী ফরহাদ? কিছুটা আশ্চর্য হতে হয়, আশ্চর্য না বরং আনন্দিত হই ফরহাদের ভাইবোনদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে। ফরহাদরা দুই ভাই দু বোন। বড় বোন রোকেয়া বেগম (২৮) বিবাহিত। ছোট বোন মোসা: রিক্তা (২৫) খাতুন স্নাতকোত্তর পাশ করে চাকরির জন্য অপেক্ষা করছেন। ছোট ভাই মোসা: গোলাম কিবরিয়া (২৩) পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ফরহাদ পড়ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ, স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে। কোনো বাবার পক্ষে গাড়ি চালানোর স্বল্প আয় দিয়ে তিনটি সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা কম কথা নয়। সত্যিই গোলাম মোস্তফা একজন গর্বিত পিতা। আর এখন তো তিনি শহীদের জনক। ফরহাদ তাঁর বাবার জন্য সবচেয়ে সম্মানিত হওয়ার কাজটিই করে গিয়েছেন। ব্যক্তিজীবন মাগুরার মতো একটি ছোট্ট জেলা থেকে মেধার স্বীকৃতি রেখে ফরহাদ গিয়েছিলেন সুদূর চট্টগ্রামে। ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইতিহাস বিভাগে। ২০২১-২২ ওঁর সেশন। চোখ ভরা স্বপ্ন, আবেগ আর উদ্যম নিয়ে চবির ২৩০০ একরে পা রেখেছিলেন মাগুরার ফরহাদ। তখন কী ফরহাদ জানতেন প্রিয় ইতিহাস বিভাগে ওঁর দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করাটাও হয়ে উঠবে না? ফরহাদের বন্ধুরা কখনো কী কল্পনাও করেছিল ডিপার্টমেন্টের শান্তশিষ্ট ছেলেটি তাদের সাথে আর কখনোই ক্লাসে বসবে না? পরিবারের ছোট সন্তান ছিলেন ফরহাদ। বাব-মা সবাইকে ভালোবাসেন। তবুও ছোট সন্তান হিসেবে একটু কী বেশি আহ্লাদ দিতেন ফরহাদকে? আদরের সবচেয়ে ছোট সন্তানটিই সবার আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল ঘাতক বুলেটে। ফরহাদের পরিবারে এখন কেবল হাহাকার। ফরহাদের মা হারিয়েছেন তাঁর নাড়ি ছেঁড়া ধন। আহা ছিন্ন মুকুল জীবন! যেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছিন্ন মুকুল কবিতার মতো- “সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিল সে গিয়েছে সবার আগে সরে ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে সে দিয়েছে সকল শূন্য করে” উত্তাল সময় জুলাইয়ের ঐদিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল। স্লোগানে মুখর দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। উত্তাল দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারের পোষ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবরকম ভাবে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলন বন্ধ করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। হলে তালা লাগানো হয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের ছাত্রাবাসগুলোতেও পুলিশ-ছাত্রলীগ হানা দেয় সে সময়ে। মেস মালিকেরা মেস বন্ধ করে দিয়েছিল। ফরহাদ সম্ভবত বাধ্য হয়েই চট্টগ্রাম ছেড়েছিলেন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে না পারার দুঃখ নিয়েই নিজের এলাকা মাগুরায় আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। সারা দেশ তখন উত্তাল। স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তার গোপন কিলিং মিশন পরিচালনা আর আন্দোলনের গতি রুখতে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ৩৫ জুলাই, ২০২৪ রক্তাক্ত জুলাইয়ের দিনের হিসাবে সেদিন ছিল ৩৫ জুলাই, ২০২৪। পঞ্জিকার হিসাবে ৪ অগাস্ট ২০২৪। ৩৫ জুলাইয়ের কর্মসূচি ছিল স্বৈরাচার পতনের ২ দফা দাবিতে বেলা ১১ টা থেকে রাজধানীতে সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বিক্ষোভ ও গণসমাবেশ। সারাদেশ ইন্টারনেট শাটডাউন এবং কখনও থাকলেও অতি ধীর গতি। ঢাকায়, কুমিল্লায়, খুলনায় গুলি চললো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ নিয়ে মিছিলে হলো। মাঠে তখন মরণ কামড় দেয়ার জন্য ফ্যাসিস্ট সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিতর্কিত সংগঠন ছাত্রলীগ, সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ ও ক্যাডার যুবলীগ বাহিনী সক্রিয়। ৪ তারিখের স্লোগান ছিল- “বাঁশের লাঠি তৈরী করো বাংলাদেশ স্বাধীন করো” মাগুরায় নিয়মিত আন্দোলনে সক্রিয় থাকা ফরহাদ গিয়েছিলেন ৩৫ জুলাইয়ের বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশ কর্মসূচিতে। শ্রীপুরের রায়নগর থেকে মাগুরা শহরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। ঘটনার দিন রায়নগর থেকে একটি ইজিবাইকে করে সাতজন কয়েক দফা বাধা পেরিয়ে পারনান্দুয়ালী এলাকায় আসেন। বেলা তখন ১১ টা। শহীদের সাথে ঐদিন আন্দোলনে যোগ দেয়া সহযোদ্ধাদের কাছে জানা যায় রণক্ষেত্র দেখেও সেদিন ভয় কাজ করেনি ফরহাদের মনে। বরং ছিলেন সম্মুখ সারিতে। মিছিলের এক পর্যায়ে বেলা ১২:৩০ এর দিকে পুলিশ পিছু হটে যায়। এরপরই ঘাতক আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মিছিলের ওপর হামলা চালায়। তখন বিপরীত থেকে একটি বুলেট এসে ফরহাদের মাথায় লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে একটি নছিমন গাড়িতে হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসালয়ের চিকিৎসক পরীক্ষা করে মহাবীরকে মৃত ঘোষণা করেন। ইতিহাসের রচনা শুরু হয়। ২৪ এর শহীদ ফরহাদ অমর হয়ে রয়! জানা যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার দিন সকালেও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে ফরহাদ আলাপ করেছিলেন স্বজনদের সাথে। ফরহাদের বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলোকে’ বলেন, “সে ছোট হলেও ম্যাচিউরিটি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করত। এ কারণে কেউ তাকে আটকাতে পারেনি। ঘটনার দিন সকালে আমাকে বলল, ভাই, চলেন শহীদ হয়ে আসি।” শূন্যতা ৩৬ জুলাই অর্থাৎ ৫ অগাস্ট স্বৈরাচারের পতন হলো। খুনী হাসিনা পালিয়ে গেল কিন্ত তার আগে কেড়ে নিলো কত শত তাজা প্রাণ। বাংলার মাটি রঞ্জিত হলো শহীদের রক্তে। শহীদ ফরহাদের মতো দেশপ্রেমী দৃঢ়চেতা তরুণদের আত্মত্যাগে আমরা স্বাধীন হলাম দ্বিতীয়বারের মতো। সদা বিনয়ী, নামাজী, এলাকার সবার প্রিয় নম্র-ভদ্র আর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কাটানো ছেলেটি ৪ তারিখ বোধহয় শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তত হয়েই মিছিলে গিয়েছিল। শহীদি মৃত্যুই তো তিনি চেয়েছিলেন। তাঁর মনে তখন কেবল চধঃৎরধ ড় গঁবৎঃব জন্মভূমি অথবা মৃত্যু ! একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: ফরহাদ হোসেন, পেশা: ছাত্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ জন্ম তারিখ ও বয়স : ০১-০১-২০০২ ও (২২) শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫-০৮-২০২৪, দুপুর ২টা শাহাদাত বরণের স্থান : ওয়াব্দা ব্রিজ, ঢাকা-মাগুরা-রোড, মাগুরা দাফন করা হয় : রায়নগর কবরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: রায়নগর, নাকোল, শ্রীপুর, মাগুরা পিতা : গোলাম মোস্তফা, পেশা: গাড়ি চালক, বয়স: ৫৮ মাতা : শিরিনা বেগম পেশা : গৃহিণী, বয়স: ৫৫ ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : পৈতৃক বাড়ি ও সামান্য আবাদি জমি আছে ভাই বোনের বিবরণ ১. রোকেয়া বেগম (বোন), বয়স: ২৮, বিবাহিতা ২. রিক্তা খাতুন (বোন), বয়স: ২৫, মাস্টার্স পাশ, বেকার ৩. গোলাম কিবরিয়া (ভাই), বয়স: ২৩, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মাস্টার্স, বেকার প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারকে এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. শহীদের বোনকে চাকরি অথবা কর্মসংস্থান করে দেয়া যেতে পারে ৩. শহীদের ভাইকে চাকরি অথবা কর্মসংস্থান করে দেয়া যেতে পারে