জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০১৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : মার্কস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
“শুধু বই পড়ে, খেলনা নিয়ে খেলে আর মাঝে মাঝে বলে, মা আমি হাফেজ হব” এক শান্ত সকালে জন্ম নেয় একটি শিশু। তার নাম রাখা হয় সাফকাত সামির। নামের ভেতরেই যেন ছিল কোমলতা, আর স্বভাবেও ঠিক তেমনি শান্ত, ভদ্র, সংবেদনশীল। ছোট থেকেই বাবা মায়ের পরম আদর স্নেহে ঢাকার মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় নিজ বাসায় বড় হয় সামির। ঢাকার ব্যস্ততায় হারিয়ে না গিয়ে, সে বড় হতে থাকে মায়ের আদরে, কখনো নানাবাড়ির স্নেহে, কখনো বাবার কাঁধে চড়ে বাজার ঘুরে। সামির ছিল একমাত্র সন্তান। বাবা সাকিবুর রহমান রাজধানীর মিরপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য চাকরি করেন। সংসার চলে টেনেটুনে, কিন্তু সামিরের পড়াশোনা আর ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো কখনো ফেলে রাখা হয়নি। আশুলিয়া শহরে নানাবাড়ির উঠোনে খেলে শৈশবের বড় একটা সময় কেটেছে সামিরের। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত সামির। জামিউল উলুম মাদ্রাসার নূরানী শাখায় তার রোজকার যাওয়া। হাতে খাতার ব্যাগ, আর মুখে ছোট্ট দোয়া। খেলার মাঠের চেয়ে পড়ার টেবিলে সময় দিত বেশি। তার পড়ার ঘরটা ছিল জানালার পাশে সেই জানালা, যেটি একদিন তার জন্য মৃত্যুর দরজা হয়ে দাঁড়ায়। খেলনা গাড়ি, রঙিন বই আর মেঝেতে ছড়ানো পেন্সিলগুলো যেন আজও বলে, এখানে একদিন একটা শিশু বেঁচে ছিল। সে ছিল সাফকাত সামির। এই শিশুটি বড় হয়ে কী হতো কেউ জানে না, কিন্তু তার নিষ্পাপ চাহনি আর নিঃশব্দ বিদায় আজ আমাদের বিবেকের কাছে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। “ও তো কিছুই বুঝত না আন্দোলনের,” বিলাপ করে ওঠেন তার মা। “শুধু বই পড়ে, খেলনা নিয়ে খেলে আর মাঝে মাঝে বলে, মা আমি হাফেজ হব।” শাহাদতের প্রেক্ষাপট ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় দোতলার বাসায় চলছিল অস্থির সময়। বাইরে গুলির শব্দ, কাঁদানে গ্যাস, হেলিকপ্টারের গর্জন। বাইরে আন্দোলন চলছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে। কাফরুল থানার সামনে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সামির ছিল বাসায়। বিকেলে একটু খেলবে বলে বাবার কাছে বায়না ধরেছিল। কিন্তু গুলির আওয়াজে বাবা তাকে ঘরে থাকতে বলেন। সন্ধ্যায় চটপটি খাওয়ার কথা ছিল তার। “সন্ধ্যায় গ্যাসের ধোঁয়া এসে যখন ঘর ভরিয়ে দিল, তখন সামির জানালা বন্ধ করতে এগিয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে আসা বুলেট তার ছোট্ট চোখটা ভেদ করে দেয়,” এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন তার বাবা সাকিবুর রহমান। সামিরের চাচা পাগলের মতো কোলে তুলে ছোটেন পাশের মার্কস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। “ডাক্তার কিছু না বলেই শুধু বললেন, ‘ও আর নেই।’” বাবা সাকিবের কণ্ঠটা তখন যেন থেমে যাওয়া কোনো নদী। সঙ্গে ছিলেন আরেক চাচা মশিউর। তার কাঁধে লেগেছিল গুলি। ১৪টি সেলাই দিতে হয়েছিল তাকে। শিশু সামিরের গেঞ্জিটা আজও মা হাতে ধরে কাঁদেন। সেই রক্তমাখা কাপড়টা যেন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে থাকা প্রতিবাদের নিদর্শন। সেদিন রাতেই পুলিশ লাশ নিতে চায় মুচলেকা রেখে। মামলা করতে গেলে তারা বলেন, “মামলা হলে দাফনে দেরি হবে।” এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি আওয়ামী লীগের নেতা মো. ইসমাইল হোসেন নিজে থানায় নিয়ে যান সাকিবকে। “কোনো অভিযোগ করিনি আমি। শুধু বলেছি আমি লাশ দাফন করতে চাই,” বাবা সাকিবের কণ্ঠে তখন একধরনের পরাজয় নয়, যেন শোকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক প্রতিবাদ। প্রথম জানাজা হয় মিরপুরে, বাসার সামনে। এরপর ২০ জুলাই, আশুলিয়ায় হয় দ্বিতীয় জানাজা। গৌরিপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয় সেই নিষ্পাপ মুখটাকে। এত শিশু-কিশোরকে কেন গুলীতে মরতে হলো প্রশ্ন সাধারণ মানুষের? সেদিন সাধারণ মানুষের মুখে ঘুরে বেড়িয়েছিল একটি প্রশ্ন: “একটা শিশু জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মরবে কেন?” “কে নেবে এর দায়?” কেউ উত্তর দেয়নি। সাফকাত সামির এখন আর খেলতে বের হয় না। সে এখন ঘুমিয়ে আছে আশুলিয়ার গৌরিপুর কবরস্থানে। কিন্তু তার রক্তে রাঙা জানালার গল্প এখনও জীবিত। বিশেষ ব্যক্তিদের অভিমত শিশু শহীদ সাফকাত সামিরকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রিফাত রশিদের বক্তব্য: মিরপুরে ১১ বছরের শহীদ হওয়া বাচ্চাটার নাম সাফকাত সামির। মিরপুরে শহীদ হওয়া ছেলেটা বেড়ে উঠেছে আশুলিয়ার যেই মহল্লায় তার নাম গৌরিপুর, আমার মহল্লা। নানাবাড়িতেই বড় হয়েছে সামির। সামিরের মা আমাদের এলাকার বড় আপু, তার সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়, মাঝেমধ্যে কথা বলতে গিয়েও বলতে পারি না। আপুর চোখের দিকে তাকাতে ভয় লাগে। এই অভ্যুত্থানে এদেশের মানুষের ত্যাগটা আমাকে সবচেয়ে বেশি মনে করায় শহীদ সাফকাত সামিরের কবর। সামির আমার এলাকার ভাগ্নে, কিন্তু বাস্তব জীবনে সামির আমার নেতা, আমার ইন্সপিরেশন, আমার আইডল। সামিরের মৃত্যুর পর শোক থেমে থাকেনি। প্রতিবাদের দাবানলও নেভেনি। মামলায় অভিযোগ খুনি শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে রাজধানীর কাফরুল থানা এলাকায় অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীর গুলীতে জামিউল উলুম মাদ্রাসার নূরানি দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাফকাত সামিরকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবীরের আদালতে রোববার (২ সেপ্টেম্বর ২০২৪) শহীদের বাবা মো. সাকিবুর রহমান চৌধুরী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দী গ্রহণ করে কাফরুল থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ) সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র বলছে, এর আগে একই ঘটনায় কাফরুল থানায় মামলা হওয়ায় দুটি মামলা একত্রে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মাসুম খান গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। মামলার অপর উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, আওয়ামী শীর্ষ সন্ত্রাসী ওবায়দুল কাদের, পেটুয়া আসাদুজ্জামান খান কামাল, খুনি আনিসুল হক, সন্ত্রাসী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, হাবিবুর রহমান, মেহেদী হাসান (পলাশ) ও মো. ফারুকুল আলমসহ প্রমুখ। মামলায় আরও ৫০/৬০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ২০২৪ আসামীদের নির্দেশে অজ্ঞাত আসামীর গুলীতে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সাফকাত সামির নিহত হয়। অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা সাফকাত সামিরের পরিবার বর্তমানে আর্থিক সংকটে দিন পার করছে। বাবা সাকিবুর রহমান একটি ছোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, যা পরিবারের ন্যূনতম খরচ চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। পরিবারটির দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা প্রয়োজন: ১. শহীদ শিশুর নামে শিক্ষা সহায়তা তহবিল গঠন ২. পরিবারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও চিকিৎসা সহায়তা ৩. পিতাকে স্বাবলম্বী করতে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোগে সহায়তা ৪. শহীদ পরিবারকে একটি স্থায়ী ঘর দেওয়া উচিত ৫. পরিবারকে মাসিক ভাতা ও এককালীন ক্ষতিপূরণ ৬. গুলিবিদ্ধ চাচার চিকিৎসা ব্যয় সরকারিভাবে বহন করা এক নজরে শহীদ সাফকাত সামির নাম : সাফকাত সামির পিতা : সাকিবুর রহমান জন্ম : ২০১৩ বয়স : ১১ বছর শিক্ষা : জামিউল উলুম মাদ্রাসা, নূরানী দ্বিতীয় শ্রেণি বর্তমান ঠিকানা : মিরপুর-১৪, ঢাকা স্থায়ী ঠিকানা : চাটখিল, নোয়াখালী শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, সন্ধ্যায় স্থান : মিরপুর-১৪, কাফরুল থানা কারণ : জানালা বন্ধ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ আক্রমণকারী : পুলিশ চিকিৎসা : মার্কস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত ঘোষণা জানাজা : প্রথম জানাজা মিরপুর, বাসার সামনে, দ্বিতীয় জানাজা ২০ জুলাই ২০২৪ আশুলিয়া (নানাবাড়ী) দাফন : ২০ জুলাই ২০২৪, আশুলিয়া গৌরিপুর, সকাল ০৮:৩০ মিনিট