Image of মো: রেজাউল করিম

নাম: মো: রেজাউল করিম

জন্ম তারিখ: ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : ছাত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মীরহাজিরবাগ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রেণি: ৭ম শাহাদাতের স্থান: কুতুবখালী টোল প্লাজা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

শহীদের জীবনী

রক্তে রাঙানো কিশোর, একটি সাহস, একটি প্রতিবাদ একটি অগ্নিস্নান শহীদের পরিচয় ঢাকার পুরনো এক অলিগলির একপাশে ছোট্ট একটি বাড়ি। নম্বর ৩৯, মীরহাজিরবাগ, যাত্রাবাড়ী। এখানেই বেড়ে উঠেছিল এক স্বপ্নবাজ কিশোর, নাম মোঃ রেজাউল করিম। বাবা মোঃ আল-আমিন মীর পেশায় একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, আর মা রাশিদা বেগম একজন গৃহিণী। আয় সামান্য, মাসে মাত্র বিশ হাজার টাকা, কিন্তু পরিবারের স্বপ্ন ছিল বিশ কোটি টাকার চেয়েও দামি। তিন সন্তান নিয়ে চলা এই পরিবারের আশা ছিল রেজাউল, তাদের একমাত্র পুত্র, যিনি একদিন আলোর পথ দেখাবেন। ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার মাটিতে জন্ম নেওয়া এই কিশোরের জীবন যেন ছিল কুরআনের আয়াতে লেখা পবিত্র, স্পষ্ট, দৃঢ়। মীরহাজিরবাগ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রেজাউল হাফেজি শিক্ষায়ও পিছিয়ে ছিল না। সাত পারা মুখস্থ করে সে যেন তার ধর্মীয় শিক্ষা এবং পার্থিব শিক্ষার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে নিচ্ছিল। ঘরে তার দুই বোন ফাতেমাতুজ জোহরা, বদরুন্নেছা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া এবং ছোট বোন তানজিলা আক্তার, চতুর্থ শ্রেণি। এই ছোট্ট পরিবার, কঠিন আর্থিক বাস্তবতা, কিন্তু রেজাউলের মনে ছিল বিস্তৃত স্বপ্নের নীড়। বিপ্লবের পূর্বাভাস : ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটভূমি ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে সারাদেশজুড়ে এক অশান্ত হাওয়া বইতে শুরু করে। স্বৈরাচারী সরকারের নিপীড়ন, বিচারহীনতা, বাকস্বাধীনতার দমন, শিক্ষা ও জীবিকার সংকটে সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ে। রাস্তায় নামে ছাত্র-জনতা, শ্রমিক, দিনমজুর। ঢাকার রাজপথে, বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর, শ্যামলী ও মতিঝিলের মতো এলাকাগুলো যেন পরিণত হয় ছোট ছোট বারুদের স্তূপে যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় প্রতিদিনই বন্ধ। রাষ্ট্র ভয়ে কাঁপে, আর কিশোরেরা সাহস জোগায়। রেজাউলও এই সময়ের সন্তান। স্কুল বন্ধ থাকলে কখনো বাবার সঙ্গে কাজে যেত, কখনো মায়ের কাজে হাত লাগাত। কিন্তু এই কিশোরের চোখে ছিল একটি বড় স্বপ্ন একটি অন্যায়হীন বাংলাদেশ। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে গোপনে আন্দোলনে যোগ দিত। চোখে ছিল দৃঢ়তা, হৃদয়ে ছিল আদর্শ। যে দিন ইতিহাসে লিখা হলো এক কিশোরের নাম ০৪ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ২:৩০। রেজাউল মাকে বলে বেরিয়ে যায় “বন্ধুদের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি।” হয়তো সে বুঝেছিল, তার পথ আজ একটু ভিন্ন। ঢাকার কুতুবখালী টোল প্লাজা তখন উত্তপ্ত। বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ বারবার টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট আর সরাসরি গুলি চালাচ্ছিল। সন্ধ্যা ৭:৩০ হঠাৎ এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে রেজাউলের বাড়িতে। আতঙ্কিত মা রাশিদা বেগম ফোন ধরতেই অপর প্রান্তে এক কণ্ঠ বলে, আপনার ছেলে রেজাউল গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাচ্ছি।” এরপর কল কেটে যায়। মা বারবার কল ব্যাক করলে এক পথিক জানান, ছেলেটা যাত্রাবাড়ী থানার পাশে কুতুবখালী টোল প্লাজার কাছে গুলিবিদ্ধ হয়। এখন সে হাসপাতালে।” রাত ৮:০০ টায়, রেজাউল জীবনের কাছে হার মেনে নেয়। গুলির ক্ষত বুকে বয়ে নিয়ে সে চলে যায় এক নতুন দিগন্তের পথে, যেখানে শহীদেরা ঘুমায়, ইতিহাসে স্থান পায়। শোক আর স্মৃতির মিছিলে পরিবার শহীদের লাশ যখন বাড়িতে আসে, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা। আমার ছেলে! আমার পবিত্র সন্তান! সে তো শুধু কুরআন মুখস্থ করছিল! সে তো শুধু সঠিকের পাশে দাঁড়িয়েছিল!” পিতা মোঃ আল-আমিন, যার ডান পায়ের হাঁটুতে সমস্যা, বসে পড়েন মাটিতে। তিনি আর কোনো শব্দ করতে পারেন না। দাদী মোসাম্মৎ রাশেদা বেগম স্মৃতিচারণ করেন সে কখনো কোনো খারাপ কথা বলেনি। সালাম না দিয়ে কখনো কারো সামনে যেত না। আমাকে না ডেকে কিছু খেত না। এখন কে আমাকে ‘দাদী’ বলে ডাকবে?” সেই পরিবারের একটি মাত্র পুত্র আজ নেই। আয়ের উৎস কমে এসেছে, কারণ বাবা আর কাজে মন বসাতে পারেন না। মা দিনের পর দিন নিঃশব্দে কাঁদেন। ঘরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি জানালা যেন আজ রেজাউলের অভাব ঘোষণা করছে। আজ রেজাউলের কবর শুধু একটি দেহকে বহন করছে না এটি বহন করছে একটি প্রজন্মের ন্যায়বোধ, একটি পরিবারের আশা, একটি জাতির জাগরণের প্রতীক। পথিকরা দাঁড়িয়ে পড়ে, কবরের পাশে ফিসফিস করে। সে ছিল কিশোর, তবুও রাষ্ট্র ভয় পেয়েছিল তাকে।” চূড়ান্ত সত্য : একটি জাতির আয়না মোঃ রেজাউল করিম আমাদের চোখে শুধু এক কিশোর নয় তিনি আমাদের বিবেকের দর্পণ। তার আত্মত্যাগ প্রমাণ করে, সাহস বয়সের উপর নির্ভর করে না। এই রাষ্ট্র যখন নিরপরাধদের হত্যা করে, তখন রেজাউলের মতো শহীদেরাই ইতিহাসের প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে। একজন রেজাউলের মৃত্যু, একশো রেজাউল জন্ম দেয়। আমরা বলি “তুমি রক্ত দিলেই প্রভাত হয়, তুমি না জাগালে আমরা ঘুম ভাঙাতে পারতাম না।” রেজাউলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে যদি কেউ শপথ নেয়, “আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করব” তাহলে রেজাউলের মৃত্যু বৃথা যায় না। একটি শিশু রাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়েছিল, সাহসে ভর করে। একটি কিশোর রাষ্ট্রের বুলেটকে তুচ্ছ করে সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছিল। একটি পরিবার সন্তান হারালেও, একটি জাতি পেল শহীদ। মৃত্যু দিয়ে সে ইতিহাস লিখে গেল, কান্না দিয়ে নয়, সাহস দিয়ে পথ দেখিয়ে গেল।” শহীদের নামে আমাদের কণ্ঠে প্রতিজ্ঞা হোক: “আর কোনো রেজাউল যেন গুলি খেয়ে না মরতে হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব রেজাউলদের হাতে থাক সত্যের পতাকা, নয়তো ভবিষ্যৎ থমকে যাবে।” এই লেখাটি শহীদ রেজাউল করিমের প্রতি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি, একটি স্বাক্ষর, একটি সনদ যে কিশোর একদিন আমাদের চোখে সাহসের সংজ্ঞা লিখে গেছে। প্রস্তাবনা "রক্তে রাঙানো কিশোর : শহীদ মোঃ রেজাউল করিমের গল্প" এই লেখাটি শুধু একটি কিশোরের জীবনের গল্প নয়, এটি এক অন্যায়বিরোধী কণ্ঠস্বর, একটি প্রতিবাদের অগ্নিশিখা, একটি জাতির বিবেকের জাগরণ। ইতিহাস সাক্ষী, কখনো কখনো সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রদীপ জ্বলে ওঠে সবচেয়ে অল্প বয়সের হাতে। মোঃ রেজাউল করিম সেই প্রদীপ, যিনি নিজের তাজা রক্ত দিয়ে আলোকিত করে গেছেন নিপীড়িত বাংলার ভবিষ্যৎ পথচলা। এ গ্রন্থে আমরা খুঁজে পাই এক কিশোরের স্বপ্ন, একটি পরিবারের আশা, এক রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা এবং এক সমাজের সাহসের নির্যাস। রেজাউলের জীবন ও মৃত্যু আমাদের শেখায় সাহস বয়স দেখে না, প্রতিবাদ কখনোই নিঃশব্দে থাকে না, আর শহীদ কখনোই হারিয়ে যায় না; তারা হয়ে ওঠে প্রতিটি ন্যায়সংগ্রামের ছায়াসঙ্গী। এই লেখাটি শহীদ রেজাউল করিমকে উৎসর্গ করা এক নিবেদন যেন আমরা ভুলে না যাই, কোথা থেকে এসেছি, কী হারিয়েছি, আর কেন আবার দাঁড়াতে হবে। এই কিশোরের আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দিক, অনুপ্রেরণা দিক, এবং আমাদের বিবেককে বারবার নাড়া দিক যেন আর কোনো মা সন্তান হারিয়ে কাঁদে না, আর কোনো অন্যায় নিরব ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে না থাকে। এই স্মরণপত্র শুধু একটি আত্মজীবনী নয়, এটি একটি প্রতিবিম্ব রাষ্ট্রের, সমাজের এবং আমাদের নিজেদের। পাঠকের হৃদয়ে যদি সাহসের স্পর্শ রেখে যেতে পারে, তবে তবেই রেজাউলের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।একনজরে প্রস্তাবনা ১. শহীদের পিতার কর্মসংস্থান করে দেওয়া যেতে পারে। ২. শহীদের দুই বোনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া যেতে পারে। ৩. পরিবারকে মাসিক বা এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে। এক নজরে শহীদ পরিচিতি শহীদের পূর্ণ নাম : মো: রেজাউল করিম জন্ম তারিখ : ০১-০২-২০০৯ জন্মস্থান : ঢাকা পেশা : ছাত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মীরহাজিরবাগ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রেণি: ৭ম স্থায়ী ঠিকানা : বাসা-৩৯, এলাকা: মীরহাজিরবাগ, থানা: যাত্রাবাড়ি, জেলা: ঢাকা বিশেষ কৃতিত্ব : ৭ পারা, হাফেজী শেষ করেছে পিতার নাম : মো: আল-আমিন মীর, পিতার পেশা ও বয়স: ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, ৪৯ মায়ের নাম : রাশিদা বেগম, মায়ের পেশা ও বয়স: গৃহিনি, ৪০ মাসিক আয় : ২০,০০০ আয়ের উৎস : পিতার কাজ পরিবারের সদস্য : বোন ২ জন ১. ফাতেমাতুজ জোহরা (২০), বদরুন্নেছা কলেজ, দ্বাদশ ২. তানজিলা আক্তার (১২), মীরহাজিরবাগ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, ৪র্থ ঘটনার স্থান : কুতুবখালী টোল প্লাজা আক্রমণকারী : পুলিশের গুলি আহত হওয়ার তারিখ : ০৪/০৮/২০২৪, সময়: সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনট মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ০৪-০৮-২০২৫, সময় : রাত ৮:০০টা শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : জুরাইন কবরস্থান

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: রেজাউল করিম
Image of মো: রেজাউল করিম
Image of মো: রেজাউল করিম

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

রাসেল মিয়া

মো: সাব্বির হোসেন

রমিজ উদ্দিন আহমেদ

মো: মেহেদী হাসান

মো. রফিকুল ইসলাম

অজ্ঞাত

আকরাম খান রাব্বি

মো: আহমাদ আব্দুল্লাহ

মো: নাদিম

আবু ইসাহাক

শাওন তালুকদার

মো: হোসেন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo