জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,ঢাকা
শহীদ মোঃ আসিফ হাসান ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার অন্তর্গত নোয়াপাড়া ইউনিয়নের আস্কারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ মাহমুদ আলম ও মাতার নাম মোছাঃ মরিয়ম বেগম। নিজগ্রামের আস্কারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই হাতেখড়ি হয় মোঃ আসিফ হাসানের। ছোট থেকেই আসিফ ছিলেন বেশ ভদ্র ও পরোপকারী। পাশাপাশি ছিলেন ইসলামের প্রতি বেশ অনুরক্ত ও ধার্মিক। নিজে যেমন অন্যায় করতেন না, তেমনি অপরের কোনো অন্যায় দেখলেও সাথে সাথে প্রতিবাদ করতেন। এজন্য এলাকার ছোট বড় সবার স্নেহ আর ভালোবাসার পাত্র ছিলেন তিনি। দ্বীপ্তিময় শহীদ আসিফের সে দিনের গল্প বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র জনতার চলা প্রতিটি কর্মসূচিতে শহীদ আসিফ হাসান প্রতিদিন অংশগ্রহণ করতেন। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ ও স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের অনুগত সন্ত্রাসীদের একের পর এক হামলার কথা শোনা যাচ্ছিল দেশজুড়ে। আন্দোলন তখন ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে। দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন সরকারের জঘন্য হামলা আর ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। ঘটনার রেশ ছড়িয়ে গিয়েছিল উত্তরাতেও, শহীদ আসিফ আন্দোলনের শুরু থেকে প্রতিদিনই উত্তরার বিভিন্ন পয়েন্টে মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন এবং বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। আর সবাইকে আন্দোলনে আসতে উৎসাহ দিতেন। দিনটি ছিল ১৮ই জুলাই, ২০২৪ সেদিন সকালে তিনি ও তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা মিলে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ঐদিন সকাল ১১ টা থেকে তিনি উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত ছাত্র সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পাশাপাশি আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রছাত্রীদের পানি, বিস্কুট, কেক সরবরাহ করছিলেন। এমন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেও একের পর এক কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট আর শর্ট গানের গুলি চলতে থাকে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এমন নৃশংস হামলার কথা হয়তো ইতিহাসের কুখ্যাত নৃশংসতাগুলোকেও ছাপিয়ে যায়। দুপুর আনুমানিক ১ টায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার মিছিলে এবার একের পর এক গুলিবর্ষণ করে। অনেক ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ জনতা ও পথচারী আহত হন। তাদের অনেককেই হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছিলেন শহীদ আসিফ। এক পর্যায়ে আহত হলেন তাঁর বন্ধু শাহ আলম। বন্ধুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও একপ্রকার তাকে জোর করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন আসিফ। নিজে রয়ে গেলেন আন্দোলনের মাঝেই। তখনও মিছিলের সম্মুখভাগে তিনি; মিছিলের সামনের দিকে থাকায় এবার ঘাতক পুলিশের লক্ষ্যবস্তু হয় সে। ঠিক তার বুক বরাবর তাক করে একের পর এক গুলি করা হল। শর্টগানের তিনটি তাজা গুলি আর অসংখ্য রাবার বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তার বুক। শহীদ আসিফ আহত হয়ে উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনের মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। স্থানীয় ছাত্র-জনতা তাকে দ্রুত উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। দীর্ঘক্ষণ আই সি ইউ-তে থাকার পর অবশেষে বিকাল ৫ টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন, দুনিয়ায় সফর শেষ হলো আসিফের। এখন থেকে তিনি শহীদ আসিফ। শহীদ সম্পর্কে ছোট ভাই রাকিব হাসান ও সহযোদ্ধাদের বক্তব্য শহীদ আসিফ হাসানের সাথে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বন্ধুরা বলেন, "আসিফ বলেছিল আমি শহীদ হলে তোরা আমার লাশ বাড়িতে পৌঁছে দিস কিন্তু তোরা বিজয় নিয়ে ফিরবি।" মুঠোফোনযোগে শহীদ আসিফ হাসানের ছোট ভাই রাকিবের সাথে কথা হলে সে কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলে, "আমার ভাই একটু জেদি ছিল কিন্তু ন্যায়পরায়ণ আর মেধাবী ছিল। তাঁর সামনে কোনো অন্যায় হলে ভাইয়া সহ্য করতে পারতেন না। পাশাপাশি খুব অতিথি পরায়ণ ছিল। ভাইয়া, খুব খেলাধুলা করতো আর এলাকার সবাইকে সব সময় মাতিয়ে রাখতো।" নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শহীদ আসিফ হাসান এর স্মৃতিফলক উন্মোচন ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় আয়োজিত বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানে শহীদ আসিফকে নিয়ে এমন অনেক আবেগঘন স্মৃতির গল্প তুলে ধরেন, তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধারা। সে অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, "যখন শহীদ আসিফকে দেখি, যখন শহীদের মর্যাদা বুঝি, তখন বেঁচে থাকাটাই অপরাধের মনে হয়।" পারিবারিক অবস্থা শহীদ মোঃ আসিফ হাসানের পরিবার মোটামুটি স্বাবলম্বী। তাঁর বাবা মৎস্য ব্যবসার সাথে জড়িত আর মা গৃহিণী। মূলত অন্যের পুকুর লিজ নিয়ে মৎস্য ব্যবসা করলেও স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের দিন চলে যায়। তাই পাঁচ সহোদর ভাই-বোন আর পিতা-মাতাকে নিয়ে ছিল তাঁদের সুখের সংসার। শহীদ আসিফের বড় তিন বোন বিবাহিত আর ছোট ভাই রাকিব হাসান সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। একনজরে শহীদের পরিচয় শহীদের পূর্ণনাম : মো: আসিফ হাসান জন্ম তারিখ : ১ জানুয়ারি, ২০০৩ পেশা : নর্দান ইউনিভার্সিটি, ইংরেজি বিভাগ, স্নাতক চতুর্থ বর্ষ পিতার নাম : মো: মাহমুদ আলম পিতার পেশা ও বয়স : ক্ষুদ্র ব্যাবসা, ৭০ বছর মাতার নাম : মোসা: মরিয়ম বেগম মাতার পেশা ও বয়স : গৃহিণী, ৬০ বছর পরিবারের মাসিক আয় : ২০০০০ টাকা পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা : ৬ জন শাহাদাতের তারিখ : ১৮ জুলাই ২০২৪ ভাই-বোনের বিবরণ ১. নাম: মাকসুদা মুন্নী, বয়স: ৪০ বছর, পেশা: গৃহিণী, শহীদের সাথে সম্পর্ক: বোন ২. নাম: মুন নাহার বেগম, বয়স: ৩৫ পেশা: গৃহিণী, শহীদের সাথে সম্পর্ক: বোন ৩. নাম: জেসমিন সুলতানা, বয়স: ৩০, পেশা: গৃহিণী, শহীদের সাথে সম্পর্ক: বোন ৪. নাম: রাকিব হাসান, বয়স: ২২ পেশা: ছাত্র, শ্রেণি: স্নাতক প্রথম বর্ষ, শহীদের সাথে সম্পর্ক: ছোট ভাই স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা: গ্রাম: আস্কারপুর, ইউনিয়ন: নাওয়াপাড়া, উপজেলা: দেবহাটা, জেলা: সাতক্ষীরা পরিবারটির সহযোগিতা প্রসঙ্গে পরামর্শ ১। শহীদের বাবাকে তার ব্যবসা সম্প্রসারিত করার স্বার্থে কিছু অর্থ সহযোগিতা করা যেতে পারে ২। শহীদের গ্রামে তাঁর জন্য কল্যাণময় কোনো সামাজিক কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে