জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৬ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা: চাকরি, রেনাটা লিমিটেড, ছাত্র, যশোর এম এম কলেজ, মাস্টার্স শাহাদাতের স্থান: বরগুনা, আমতলী পৌরসভার মেয়র মতিয়ার রহমানের বাসা
আল আমিন হোসাইনের বাড়ি যশোরের চৌগাছা উপজেলার আফরা গ্রামে। আল আমিন হোসাইন যশোরের সন্তান হলেও কাজ করতেন সেলসম্যান হিসেবে রেনাটা কোম্পানীতে। তার কর্মস্থল ছিল বরগুনা জেলার আমতলী। তার বাবার নাম আনোয়ার হোসাইন। তিনি কৃষিকাজ করেন। মা আশুরা বেগম গৃহিনী। আল আমিন যশোর এম এম কলেজে মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট স্বৈরাচারী সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে একে একে সমস্ত বিরোধী দল ও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করতে থাকে। শুরুতে ভারতের সহায়তায় পিলখানায় হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ৭৬ জন সেনা অফিসারসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। সাবেক দূর্নীতিবাজ স্বৈরাচার সরকার শেখ মুজিব ও তার হিংস্র রক্ষী বাহিনীকে যারা দমন করেছিল সেইসব বিপ্লবী সেনাদের মধ্য থেকে ৫ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে আটক করে এবং তার বড় সন্তানকে পিটিয়ে আহত করে। তিনি বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হন। খালেদার অপর সন্তান আওয়ামী নির্যাতনের ফলে স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে শেখ হাসিনার অবৈধ কাজের শক্ত প্রতিবাদ করতে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি অক্ষম হয়ে পড়ে। হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে ভারতীয় হাইকমিশনারের মাধ্যমে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। এরশাদের দলকে ধীরে ধীরে স্বৈরাচার সরকার পোষা বিরোধী দল বানিয়ে ফেলে। দেশবাসী এ দলটিকে হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে ঘৃণা করা শুরু করে। আওয়ামীলীগ এবং তার প্রশ্রয়দাতা ভারত বুঝতে পেরেছিল এদেশের সম্পদ লুন্ঠনের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় এই দলের উপরে নির্মম নির্যাতন। জেল, গুম, খুন, ক্রসফায়ার, ধর্ষণ, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়াসহ এমন কোন নির্যাতন ছিলোনা যা এই দলের নেতা-কর্মীদের উপরে চালানো হয়নি! মিথ্যা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলে জামায়াত নেতাদের ৫ জনকে একের পর এক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এসব নেতাদের প্রাণভিক্ষা চাইতে বলা হয়েছিল। শেখ হাসিনা প্রস্তাব দিয়েছিল, প্রাণ ভিক্ষা চাইলে হয়তো ক্ষমা করে দেওয়া যেতে পারে! জামায়াত নেতারা জালিমের কাছে আনুগত্য স্বীকার না করে শাহাদাতকে বেছে নেন। ২০০৯ সালে সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসার পরে আওয়ামী মদ্যপ-লম্পট নেতারা স্বপ্ন দেখাতো অমুক অমুক সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধা ভারতকে প্রদান করলে বাংলাদেশ চার বছরের মধ্যে কানাডা-সিংগাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু ৫ বছরের মধ্যে জনতা তাদের জমাকৃত সম্পদ ও দেশের সম্পদ হারাতে দেখে বুঝতে পারে দেশটা রাক্ষসের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসতে পারবেনা বুঝতে পেরে ২০১৪ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনের আয়োজন করে। ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে দেখে তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদকারীদের জেল-জুলুম, গুম-খুনের মাধ্যমে একপর্যায়ে দেশ থেকে নিরুদ্দেশ হতে হয়। আলেম সমাজ উপলব্ধি করেন সর্বত্র ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডে দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের কোনঠাসা করে ফেলা হচ্ছে। লম্পট ও নাস্তিকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। এসময় সরকারী প্রশ্রয়ে নবী (স) কে অপমান করে লেখালেখির কারণে শুরু হয় হেফাজতে ইসলামের ইসলাম রক্ষার আন্দোলন। ২০১৪ সালে হেফাজতে ইসলামীর সরকার বিরোধী আন্দোলনে ইসলামী দলগুলোর পাশে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির সমর্থন দিয়ে এগিয়ে আসে। হেফাজত কর্মীরা সরকারকে দাবী মানাতে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। তাদের দাবী ছিল নাস্তিক লেখকদের বিচার করা হোক। শেখ হাসিনা দাবী না মেনে গণহত্যার নির্দেশ দেয়। রাতভর চলে হেফাজত কর্মীদের গুলি চালিয়ে হত্যা। শতাধিক নিহত হয়। গণহত্যার সংবাদ প্রচার করায় দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয় সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয় অসংখ্য নিউজ মিডিয়া। সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগের চাটুকারিতা করা শুরু করে। ইসলাম পন্থীদের নির্মূলে তারা আওয়ামী সহযোগী হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে আবারো পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনা। এমনকি ২০২৪ সালেও। ছাত্র-জনতা অপেক্ষায় ছিল পরিবর্তনের। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনটি দমন করতে শেখ হাসিনা অতীতের মতো গনহত্যার নির্দেশ প্রদান করে। ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করে। তাদের ইচ্ছা ছিল সাধারণ ছাত্র-জনতাকে রাজপথে জামায়াত-শিবির অভিযোগ তুলে নির্মমভাবে খুন করবে। জুলাই মাস জুড়ে সরকারী বাহিনীর হাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এবং শত শত মানুষ নিহত হলেও আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। ছাত্র-জনতা আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেনি। ১ আগস্টে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হওয়ায় গণহত্যার কথা জেনে যায় মানুষ। ৪ আগস্ট দেশব্যাপী প্রতিরোধ শুরু হয়। এই প্রতিরোধের ফলে পরদিন ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা তার অপর দূর্নীতিবাজ ছোটবোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে তার খুনি বিভিন্ন বাহিনী যেমন- পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি প্রভৃতিকে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে যায়। একারণে ৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নে সারাদেশে ছাত্র-জনতা খুশিতে বিজয় মিছিলে বেরিয়ে এলে স্বৈরাচারী সরকারকে যারা ১৫ বছর টিকিয়ে রেখেছিল সেসব খুনি বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। রক্তাক্ত হয় রাজপথ। খুন হয় জনতার একাংশ। আহত জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা বিভিন্ন জেলায় খুনি হাসিনার সন্ত্রাসী ও চাটুকারদের আস্তানায় হামলা চালায়। এসব অফিস থেকে গত ১৬ বছর ধরে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করা হতো। বিরোধীদের ধরে এনে নির্মমভাবে পেটানো হতো। ছাত্র-জনতা আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন অফিসে আগুন দেয়। বরগুনা জেলার আমতলী পৌরসভার আওয়ামীলীগ মনোনিত মেয়র মতিয়ার রহমানের বাসায়ও আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। তার ভবনে ভাড়া থাকতেন রেনাটা কোম্পানীতে সেলসম্যান হিসেবে কর্মরত আল আমিন হোসাইন। মূলত আওয়ামী লীগের শাসনের সময় ছাত্র ও ব্যাচেলরদের মেসে আওয়ামী পুলিশ রাত-বিরাতে হামলা চালাতো। মুখে সামান্য দাড়ি থাকলে কিংবা ইসলামী লেবাসের কাউকে পেলে আটক করতো। একারণে অনেক সাধারণ ছাত্র আওয়ামীলীগ নেতাদের ভবনে আশ্রয় নিয়ে নিরাপদবোধ করতো। আল আমিন হোসাইনও সম্ভবত নিরাপত্তার কারনে এই ভবনে ভাড়া থাকতেন। ঘটনা সম্পর্কে তার ছোট ভাই মো. রাসেল হোসেন জানান, গত ৫ আগস্ট কাজ শেষে তিনি সেখানকার বাসার দ্বিতীয় তলায় ঘুমিয়ে ছিলেন। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা বাসার নিচতলায় আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় তলায়। ঘুমিয়ে থাকা আল আমিনসহ তার কয়েকজন সহকর্মীর শরীরেও আগুন লেগে যায়। তখন তারা শরীরে আগুন নিয়েই ২য় তলা থেকে লাফিয়ে রাস্তায় পড়েন। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে নিয়ে যান। পরদিন ৬ আগস্ট তাকে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। শরীরের ৩৬ শতাংশ দগ্ধ নিয়ে শুক্রবার ১৬ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টায় আইসিইউতে তিনি মারা যান। ১৭ আগস্ট চন্দরপুর পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। পত্রিকার নিউজ লিংক : https://bangla.thedailystar.net/news/bangladesh/quota-protest/news-606111 অর্থনৈতিক অবস্থা নিহতের বাবা জনাব আনোয়ার হোসেন বাবু কৃষিকাজ করেন। আল আমিনের ছোট ভাই রাসেল একটি দোকানে সময় দেন। তাদের ৪ শতাংশ জমি আছে। একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : আল আমিন হোসাইন (২৭) পেশা : কর্মচারী (রেনাটা কোম্পানী), মাস্টার্সের ছাত্র, যশোর এম এম কলেজ পিতা : আনোয়ার হোসাইন মাতা : আশুরা বেগম পরিবারের তথ্য : ভাই-১ রাসেল (২৫) মুদি দোকানদার, ভাই-২ ফয়েজ (১৩) ৬ষ্ঠ শ্রেণি স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: আফরা (চন্দরপুর), ডাকঘর: সলুয়া বাজার, থানা: চৌগাছা, জেলা: যশোর ঘটনার স্থান : আমতলী পৌরসভার মেয়র মতিয়ার রহমানের বাসা, বরগুনা আক্রমণকারী : বিক্ষুব্ধ জনতা আহত হওয়ার সময় : ৫ আগস্ট, বিকাল ৩ টা আঘাতের ধরন : আগুনে পুড়ে দগ্ধ, ১৬ আগস্ট ২০২৪, ভোর ৫:৩০ মিনিট মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : শেখ হাসিনা বার্ন হাসপাতাল, ঢাকা শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : চন্দরপুর কবরস্থান প্রস্তাবনা ১. মাসিক ও এককালীন ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা ২. ছোট ভাইকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করা