জন্ম তারিখ: ৩ মে, ১৯৯৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : পিক-আপ ড্রাইভার (জামান অটো), শাহাদাতের স্থান :অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্তদেরকে উদ্ধারকার্যে নিহত, জাবির হোটেল, চিত্রার মোড়, যশোর
আঁধার ঘুচাতে আলোর মশাল নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো আবির্ভূত হয়েছেন শহীদ হাফিজ" শহীদ হাফিজ উদ্দিন ১৯৯৫ সালের ৩ মে যশোর সদরে পূর্ব বারান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৃত আব্দুল খালেক এবং মায়ের নাম রাজিয়া খাতুন। শহীদ হাফিজের পরিবারে চার ভাই ও চার বোন ছিল। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য়। বড় ভাই মইনউদ্দিন (৩৮) মালয়েশিয়া থাকেন। মেজ ভাই মইজ উদ্দিন ২০০৯ সালে ইন্তেকাল করেছেন। ছোটভাই ইব্রাহীম (২২) স্থানীয় একটি বেসরকারি (কওমী) মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। চার বোনের সকলেই বিবাহিতা। ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই তাঁর পরিবার ফরিদপুর থেকে যশোরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ফরিদপুরে তাঁদের পৈতৃক কোন জায়গাজমি নেই। যশোর শহরে বাসাভাড়া করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করলেও সম্প্রতি ভাইয়েরা মিলে (বিশেষ করে বড় ভাইয়ের সহযোগিতায়) থাকার জন্য যশোর পৌরসভার বাহিরে বাউলিয়া চাঁনপাড়া এলাকায় বাড়ি করার জন্য একটি জমি ক্রয় করেছেন। বাড়ি করার মতো আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় এখনও ভাড়া বাড়িতেই বসবাস করছেন। পরিবার সামগ্রিকভাবে খুব বেশি সচ্ছল নয়! হাফিজ ৮০০০/ টাকা বেতনে পিকআপ ড্রাইভার হিসাবে চাকুরিরত ছিলেন। এই টাকা দিয়ে নিজের এবং সংসারের খরচ চালাতেন। শহীদ হাফিজের ভাই বোনদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই ভালো ছিলো। যার কারণে মা, বোন ও বোনের পরিবার, ভাই ও ভাইয়ের পরিবার সহ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে তিনি একই বাসায় থাকতেন। ২৪ এর সংগ্রাম ছিলো এদেশের আপামর ছাত্র-জনতার সংগ্রাম। সকল শ্রেনীপেশার মানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণে ঘটা এক সফল বিপ্লব। রিক্সাওয়ালা, মুদি দোকানদারসহ সকল পেশাজীবী মানুষের। এমন মানুষও এই আন্দোলনে শরীক হয়েছেন, যাদের পরিবার চালাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। উদ্দেশ্য একটাই, দীর্ঘ পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদের জুলুমের অপসারণ। আর তাই ছাত্রদের এক দফার দাবিতে পুরো দেশ উত্তাল হয়ে উঠে। এ লড়াইয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানও সরাসরি অংশগ্রহণ করে। স্বৈরাচার পতন ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এমনি এক ধার্মিক তরুণ শহীদ মো: হাফিজ উদ্দীম সরাসরি সক্রিয় ছিলেন। ৫ আগষ্ট যখন স্বৈরাচারী হাসিনা পদত্যাগ করলো, এদেশের আপামার জনতা বিজয়োল্লাসে মত্ত। এ সুযোগে কিছু দুর্বৃত্ত যশোর চিত্রার মোড়ে আওয়ামীলীগ নেতার মালিকানাধীন জাবের হোটেলে আগুন লাগায়। সেখানে বেশ কিছু ছাত্র-জনতা আটকে পড়ে যায়। সেই আগুনের চিমনি থেকে জনতাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে হাফিজ। অতঃপর তিনি আগুনে পুড়ে জুলাই বিপ্লবে শহীদ হিসাবে নাম লেখান। ঘটনার বিবরণ ২৪ এর জুলাই বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলো এ দেশের আপামর জনতা। বিপ্লবে যেমন উঁচুশ্রেণী, মধ্যশ্রেণী, ছাত্রদের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল, ঠিক তেমনি বিরাট একটা অংশ নিম্নবিত্তের আত্মত্যাগ ছিলো। উঁচুশ্রেণী কিংবা মধ্যবিত্তের সংগ্রামের কথা আলোচিত হলেও বিপ্লব থেকে আড়ালে পড়ে গেছে নিম্নবিত্তের অকুতোভয় সংগ্রামের কথা। জুলাই মাসে সারা দেশ যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল তখন সবার সাথে শহীদ হাফিজও ছিলেন রাজপথে। ভাগ্নে বোরহান উদ্দিন সহ আরও কিছু বন্ধু ও এলাকার ভাইদের নিয়ে নিয়মিতই যেতেন আন্দোলনে। আগস্ট মাসের ৫ তারিখ যখন স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলো তখন সারাদেশের মতো যশোর শহরেও শুরু হয়েছিলো বিজয় মিছিল, আনন্দ উল্লাস। এমন সময় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে পুড়তে থাকে যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে চিত্রার মোড়ে অবস্থিত ৫ তারকা হোটেল "হোটেল জাবের"। হোটেলে যখন অগ্নিকান্ড হয় তখন শহীদ হাফিজ তার ভাগ্নেসহ ৪ জন বিকাল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে যান। আগুনে আটকে পড়া লোকদের আর্তচিৎকার শুনে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে হোটেলের ভিতরে ঢুকে পড়েন। কয়েক দফায় কিছু লোককে উদ্ধার করতে পারলেও এক পর্যায়ে নিজেই আটকা পড়ে যান। নিচের দিকে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় তিনি উপরের দিকে উঠতে থাকেন এবং ১১ তলা পর্যন্ত উঠে পড়েন। এক পর্যায়ে ধোঁয়ার কারনে অক্সিজেন শূন্যতায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান শহীদ হাফিজ। আগুন নিভে গেলে উদ্ধারকর্মীরা আহত এবং নিহতদের বের করে নিয়ে আসেন। এসময় শহীদ হাফিজকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং স্বজনেরা হাসপাতালের মর্গে সনাক্ত করে তার মৃতদেহ বাসায় নিয়ে যান। শহীদের নিকটাত্মীয়ের অভিব্যক্তি শহীদ হাফিজের মা ছেলেকে হারিয়ে বলেন- "আমার ছেলে অমায়িক ছেলে, সকাল বেলা উঠে সবাইকে ডেকে দিতো, নামাজ আদায় ও কোরআন তেলোয়াত করতো। যেদিন মারা গিয়েছে সেদিনও নামাজ পড়েছে। কোরআন পড়েছে।" শহীদ হাফিজের ভাগ্নে বলেন- "মামা একজন নামাজি ব্যক্তি ছিলেন। দাড়ি রেখেছিলেন। সবসময় পাঞ্জাবী-পায়জামা ও মাথায় টুপি পড়তেন। সর্বক্ষেত্রে ইসলাম পালনে সচেষ্ট থাকতেন।" আমাদের করণীয় শহীদেরা আমাদের সম্পদ। যে লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে শহীদেরা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, আমাদের উচিৎ তাঁদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা। বৈষম্যেবিরোধী এক নতুন বাংলাদেশ সংস্কার করা। এটাই হবে আমাদের শহীদদের প্রতি প্রতিদান। এছাড়াও এই শহীদদের যথাযথ স্বীকৃতি এবং তাঁদের অবদানকে সমুন্নত রাখতে হবে। তবেই তাঁদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: হাফিজ উদ্দীন জন্ম তারিখ : ৩ মে, ১৯৯৫ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- বাউলিয়া চানপাড়া, উপজেলা - যশোর সদর (পৌরসভা), জেলা: যশোর বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম- পূর্ব বারান্দি, উপজেলা- যশোর সদর, জেলা- যশোর পিতার নাম : মৃত আব্দুল খালেক মাতার নাম : রাজিয়া খাতুন স্ত্রীর নাম : মাহিয়া খাতুন পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৮ জন। ভাইয়ের সংখ্যা : ০৪ জন (মৃত-০২) বোনের সংখ্যা : ০৪ জন (বিবাহিতা) পেশাগত পরিচয় : পিক-আপ ড্রাইভার (জামান অটো) ঘটনার স্থান : জাবির হোটেল, চিত্রার মোড়, যশোর মৃত্যুর কারণ : অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্তদেরকে উদ্ধারকার্যে নিহত মৃত্যুর সময় : ৫ আগস্ট, বিকেল ৪:০০ থেকে ৮:০০ টা প্রস্তাবনা প্রস্তাবনা-১: মাসিক অথবা এককালীন আর্থিক সাহায্য করা যেতে পারে প্রস্তাবনা-২: শহীদ স্ত্রীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে